আজান হচ্ছে। কানের ভেতরে তা বাজছে। মনের আবছা পর্দায় কিছুই দেখতে পায় না জাফরুল। সেখানটায় কোনো আলো নেই। নামাজ পড়তে হবেÑ এটা মনে উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু কোন অক্তের নামাজ তা মনে পড়ছে না। সে বুঝতে পারছে না সময়টা সকাল না সন্ধ্যা। রোদ উঠে গেলে মন টানে না নামাজে। রোদ কি উঠে গেছে! সে নিজেকে জোর করে টেনে তোলে বিছানার ওপর। চোখ কচলে নেয়। তাকায় বাইরে। না, রোদ ওঠেনি। সে বিছানা ছেড়ে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বারান্দায় আসে। দক্ষিণের এই বারান্দাটা তার খুব পছন্দ। সামনে খোলা আকাশ আর বাতাস। পরান জুড়িয়ে যায় দখিনা বাতাসে। মনে পড়ে, দখিন হাওয়া জাগো... জাগো... এক ফোঁটা বাতাসও নাইÑ জাফরুল ভ্রƒ-ভেঙে আকাশে তাকায়। গোমরামুখো আকাশ মুখ ব্যাদান করে আছে। মন খারাপ হতে শুরু করে তার। এত মেঘ আকাশে! কেন? এখন কি মেঘের কাল? ক্যাইল্যা মেঘের কাল? বোঝা যাচ্ছে না মনেও পড়ছে না এ কোন মাস। বাংলা কোনো মাসের নামই মনে আসছে না। কেন? কেন ভুলে গেছি এ কালের কথা? সে-বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢোকে। দেয়ালে ক্যালেন্ডার খোঁজে। না, তার নিজের রুমে কোনো ক্যালেন্ডার নেই। ড্রইংরুমে আছে, সে নিশ্চিত। ড্রাইনিং রুমে আসে। বেসিনের আয়নায় নিজেকে দেখে। স্পষ্ট নয় চেহারা। মুখটা কেমন যেন ভার ভার। চোখের নিচে কি পানি জমেছে? ব্রাশে পেস্ট নিয়ে উত্তরের জানালা খুলে দেয়। ঈশাণ আর নৈঋতের মাঝখানে তাকায়। ঈশাণ আর নৈঋত শব্দ দু’টি তাকে চাঙ্গা করে তোলে। বাহ! মনে পড়েছে। এ শব্দ তো হারিয়ে গিয়েছিলো। কোথায় লুকিয়ে ছিলে বাপধন! আত্মতুষ্টিতে জাফরুল নিজেকে হাল্কা মনে করে। এই একটু আগেÑ যখন গোমরা আকাশ দেখে তার মন খারাপ হচ্ছিল, আর কোন মাস তা মনে পড়ছিলো না, তখন নিজের ওপরই বেজার হচ্ছিলো সে। এমন কোনো বয়স হয়নি তার যে, দিন, মাসের নাম ভুলে যাবে। কিন্তু এখনও, ওই দু’টি শব্দ তাকে জাগিয়ে দিয়েছে বটে কিন্তু মনের অতল থেকে মাসটিকে নিয়ে আসতে পারেনি তার মনের সরোবরে। সেখানটা নিস্তরঙ্গ। ভুশ করে ওঠেনি কোনো চিতল বা কালি বাউসের মতো মাসটির নাম। আমি বাংলা মাসটিকে খুঁজছি! মনে মনে উচ্চারণ করে সে। কিন্তু ধরা দিচ্ছে না নামটি। দাঁত মাজতে মাজতে সে খুঁজতে থাকে। আয়েসী ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে আসে বারান্দায় আবার। আকাশ তাকিয়ে আছে যেন ওর মুখে। সে অনুভব করে আকাশের তাকানো, স্পর্শ পায়। চারদিক কি ফর্সা হয়ে উঠছে? সে দ্রুত ফিরে আসে বেসিনে। হাত-মুখ ধুয়ে, অজু করে নামাজ পড়তে চায় সে। মনে মনে হাসে। নামাজ পড়া নিয়ে কত যে বিত া হয়েছে শামীমের সঙ্গে। সে পড়তে চায় না নামাজ। শামীম নাছোড়বান্দা, পড়তেই হবে। জাফরুল পড়ে ফজর আর মাগরিবের নামাজ। শামীম উঠেছিলো বোধহয় সুবে-সাদেকের সময় আজানের আগেই। নাকি আমি উঠেছি আজান শুনে? হ্যাঁ, আজান শুনেই ঘুম কেটে গিয়েছিলো, কিন্তু বিছানা ছেড়ে ওঠা হয়নি। উঠতে উঠতে সকাল হয়ে গেছে। বেলা কি উঠেছে? সে দ্রুত অজু করে নেয়। নামাজ পড়ে বেডরুমে আসে। না, শামীম নেই বিছানায়। আমি যখন উঠি তখন কী ও বিছানায় ছিলো? নিজেকেই জিজ্ঞেস করে সে। মনে পড়ছে না,Ñ সে বারান্দায় আসে। মন তোমার কী হলো? সব ভুলে বসে আছো? মন বললোÑ না, সব ভুলিনি। আজ তো ১৮ এপ্রিল ২০০৭, বুধবার। তোমার কী খেয়াল থাকে না? না। আজ বাংলা মাসের কতো তারিখ। মন বললো, জাফরুল সরি, সরি বাংলা সন তো আমি রাখি না। ও চর্চা আমার নেই। জাফরুল বলে, তোমার উচিত বাংলা সনের মাস, তারিখ মনে রাখা। অবাক হলো মনÑ ওহ্! জাফরুল! আমি কিন্তু বাংলা দিনের নামটি তোমাকে বলেছিÑ আজ বুধবার। উয়েডনেসডে বলিনি। থ্যাঙ্কস। তোমাকেও বন্ধু আমার। তুমিও কিন্তু ভুলে গেছোÑ কী? থ্যাঙ্কসের বাংলাটা- ধন্যবাদ। তোমার তো চর্চা নেই প্রভু! আমি কী করে তোমাকে বলবো? তা ঠিক, তা ঠিক। স্বীকার করলো জাফরুল। নিজেকে সে তিরস্কৃৃত করলো? আকাশ আরো কালো হয়ে আসে। টের পায়নি সে। সাত-সকালে বৃষ্টি কার ভালো লাগে। কিন্তু এপ্রিল মাস তোÑ এ সময়টায় খাঁ-খাঁ রোদ আর হঠাৎ বৃষ্টির কাল। ও রোদ-বৃষ্টির দিন, কী নাম তোমার। বলো- বলো- বলো- ধাঁ করে মনের পর্দায় ভেসে উঠলো নামটি, যেন কালো মেঘ ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো তাজা বৃষ্টির ফোঁটা- বৈশাখ। আর ঝমঝম করে বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি নামলো সেই সময়ই। তাজা আর ঠাণ্ডা। মুহূর্তে বৃষ্টির শব্দে ছেয়ে গেলো চারদিক। সামনে কিছুই দেখতে পেলো না সে। শুধু মন বললোÑ আজ ৫ বৈশাখ ১৪১৪ সন। জাফরুল বারান্দা থেকে নড়তে পারলো না। সেখানে অনড় দাঁড়িয়েই সে ভিজতে থাকলো। আজকের দিনটি কি আলোহীন থাকবে?.......