স্মার্ট শাল প্রাংশু লোকচক্ষু-নজর-কাড়া চেহারার বৃদ্ধ মানুষটির অশ্রুশিক্তচোখ বেয়ে অঝরে ঝরে চলেছে সংযমহীন বারিধারা। উপস্থিত কোন ব্যক্তিরই দৃষ্টি এড়ায়নি এমন বেমানান শিশুমন-আকুল-অভিব্যক্তি। বৃদ্ধ মানুষটি সমবেত প্রায় সকলেরই পরিচিত। তাঁর উজার করা ¯েœহ-ভালোবাসা-নিবিড় হাত বাড়ানো-হৃদয় নিংরানো বন্ধুত্ব-জাগতিক সম্পর্কের এই নির্মম পরিণতি একেবারেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি। পারবেন কী করে? দিনে আট-দশবার ফোনে বাক্যালাপ, ছোট বড় যে কোন বিষয়ে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মত বিনিময়। এক যুগ সাধনা-ব্যর্থতার পরিণাম এই শায়িত কন্যার বর্তমান স্থিতি! মানবেনই বা কী করে এই নিষ্ঠুর সত্যকে! দুঃখকে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দেবার বার্তা যে তাঁরই এবং বারবার স্মরণ করিয়ে দিত এই কন্যা। সেই বার্তা-কবিতা - “সাগরকে ডেকে তুমি কথা বল/ হাত ধরে পাশে নিয়ে এগিয়ে চল/ প্রেমেতে পাগল হলে আসর-বাসর/ বেলাভূমি বেলাশেষ গোধূলি দোসর: /আর কোন কথা নয়, এগিয়ে চল/ সাগরকে ডেকে তুমি কথা বল। দুঃখ বেদনা যত, ছড়াও আকাশে/ সৌরভ হয়ে তারা ফিরবে বাতাসে/ বন্যা আনবে প্রাণ নতুন প্রকাশে/ দুঃখ ছড়িয়ে দাও বাতাসে আকাশে;/ আর কোন কথা নয়, এগিয়ে চল/ সাগরকে ডেকে তুমি কথা বল। তরঙ্গ উথলি ওঠে সিম্ফনির তানে/ সিগাল মাতাল হয় সুগভীর টানে/ নীল আরও নীল হয় সমুদ্রের দেশে/ দিশাহারা মন মোর তোমায় ভালোবেসে;/ আর কোন কথা নয়, এগিয়ে চল/ সাগরকে ডেকে তুমি কথা বল।” ভবিষ্যতে দুঃখ মোচনে কে সেই বারতা স্মরণ করিয়ে দেবে! নিজের বার্তা নিজের কাছেই আজ অর্থহীন মন হচ্ছে কবির। উত্তাল সমুদ্রসম-উদ্বেলিত-অশান্ত-টর্নেডো-মধ্যকালীন এক দুঃসহ পরিস্থিতি। পাশের ঘরে চেয়ারে বসে অবসরপ্রাপ্ত সমাজ বিজ্ঞানী ড. অনিমেষ বাৎস। দীর্ঘদিন বৃদ্ধকে গভীর মননে চেনেন, চেনেন তাঁর মানস কন্যাকেও। তাঁর চোখের কোণ চিকচিক করলেও সংযমিত ধারা নেমে আসেনি। মনে পড়ছে তাঁর এক বৃষ্টি-সন্ধ্যায় টেলিফোনে অন্তমিল কবিতা লেখার আর্জি শোনার গল্প। শুধু কবিতা সৃষ্টিই হয়নি, হয়েছিল কথা ও সুরে গান। কথার শুরু ছিল, - অঝরে নেমেছে আজ বৃষ্টি/ চারিদিক ছায়া ঘেরা/ মেঘেতে আকাশ গড়া/ ভুলের ভবেতে ভরা/ দেখ সুর সৃষ্টি... ইত্যাদি ইত্যাদি...।” আজ বৃষ্টি ছাড়াই বারিধারা সেই সুর ও বাণী ¯্রষ্টার চোখে। এতটুকু অবাক হচ্ছেন না অনিমেষ বাৎস। তিনি যে বৃদ্ধের বাৎসল্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নৃতাত্ত্বিক-সমাজ বিজ্ঞানী অনিমেষের ভাবনায় স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়-বাঙালি সংস্কৃতি বলতে বোঝা যায় সাহিত্য, সংগীত, ললিত কলা, ক্রীড়া, মানবিকতা, জ্ঞানের উৎকর্ষ, শান্তি-সৌন্দর্যের সমাহার। এর অধিকাংশ উৎসের অধিকারী এই আকুল-শিশুমন-অভিব্যক্তি-অশীতিপর বৃদ্ধ। বিকাশ, মূল্যবোধ এবং সাংগঠনিক চিন্তাতেও তাঁর অবাধ বিচরণ। অস্বীকার করার কোনো স্থানই নেই। বঙ্গীয় অঞ্চল বলতে আক্ষরিক অর্থেই তাঁর জগত কাঁটাতারের ধার ধারে না। দুই পারের বৃহৎ সংস্কৃতিসম্পন্ন সমাজে আজ এক প্রতিষ্ঠিত শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিত্ব তিনি। এই মুহূর্তের দৃশ্য-পটভূমিকায় সমাজ বিজ্ঞানীর মনের গভীরে প্রিয় কবির আরও একটা কবিতার কথা চলমান, - “দিন শেষরেশ/ বিদায় বেলায়/ এ কী দৃশ্যমান/ তাঁর আহ্বান। পেয়েছি অনেক/ অকৃপণ উজারে/ দিয়েছ ভরিয়ে আমারে/ বাকী কিছু নাই/ নাই অভিমান/ তাঁর আহ্বান।” কবির সেই কল্পদৃশ্য কী - এ দৃশ্য! বড্ড কবিতা ভালোবাসতেন এই শায়িতা সদানন্দে-থাকা মহিলা, বিশেষ করে তার হৃদয়নিংড়ানো-শ্রদ্ধাভাজন-অভিভাবক-বন্ধুর কবিতা। শায়িতাকে কী নামে পরিচয় করাবেন সমাজ বিজ্ঞানী? দুঃখসাগরে ভেসেও যিনি সর্বক্ষণ আনন্দে থাকার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁকে আনন্দা বা সানন্দা বলাই বোধ হয় শ্রেয়। এই আখ্যানে তিনি সানন্দা নামেই পরিচিত হোন। এটাই তার ইচ্ছে। উপস্থিত অলোক গোঁসাইও। উল্লিখিত এই তিনজনসহ চার আসনের অনাবিল হাসিরাশি-আড্ডার-আসর প্রায়শই বসতো ঐ বৃদ্ধের শহরতলির সাময়িক আবাসে। যোগদান করতে ছুটে আসতেন রবীন্দ্র-সাহিত্য-সংগীত সা¤্রাজ্যে-বিরাজমান সানন্দা-ভ্রাতৃত্ব¡ বন্ধনে অবরুদ্ধ ঐ গোঁসাই মহাশয়ও। বিশেষ উপভোগ্য হয়ে উঠতো হাউজিং কক্ষে তিনজন একসঙ্গে মিলিত অনাবিল সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার মুহূর্তগুলো। সেই আসরে একদিন বাকি তিনজন নীলকমলকে চেপে ধরেছিল, - নীলদত্তক নাম কেন’? উত্তরে তিনি জানান, - আচ্ছা এটা কোন প্রশ্ন হলো! নামের সব সময় কি কোন ব্যাখ্যা থাকে বা অর্থ থাকে? তবু বলছো যখন একটা অজুহাত খাড়া করার, দাঁড় করানোর চেষ্টা করা যাক। নীল বিশালত্বের প্রতীক - নীল আকাশ-নীল সমুদ্র। নীল পবিত্রতার প্রতীক - কোনো রকম বিরুদ্ধতা-বাধাপ্রাপ্ত, তা আকাশে মেঘই হোক কিংবা সমুদ্রে অন্যকোন মিশ্রণই হোক না হলে, তার স্বচ্ছতা-পবিত্রতা অসীম। নীল নিজস্বতায় মৌলিক - জন্মগত, স্বাধীন। সেই পবিত্র-স্বচ্ছ-মৌলিক ‘নীল’-কে দত্তক নেওয়া হয়েছে। কিংবা নীলই কবিকে দত্তক নিয়েছে, বলতে পারা যায়। এটাই নীলদত্তক’ শব্দের উৎস-মহিমা, যাই বলো।” আজও তারা সকলেই হাজির, এমন কি হাজির তাদের প্রিয়জন-মানুষটিও, শুধুমাত্র নিস্পন্দ-নিথর শায়িত; চিরনিদ্রায়; স্বপ্নালোকে। এ-তো নির্বাণ-মহানির্বাণ-সংসার মুক্তি-ঈশিত্ব-স্বজনমুক্তিদান-মোক্ষমার্গ গমন!