ব্যবসায়িক কাজে মাওনা, শ্রীপুর, হুতাপাড়ার দিকে প্রায় আমাকে যেতে হয়। গাজিপুর চৌরাস্তা অতিক্রম করলেই চোখে পরে রাস্তার দু'ধারে শাল ও গজার বন। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। একদিনের কথা মধ্যহ্ন দুপুর। আকাশ ঘন নীল। পিচ ঢালা পথ ধরে গাড়ি ছুটছে ঝরের গতিতে। দু'পাশে শাল বন যেন যৌবন ফিরে পেয়েছে। সবুজে সেজে উঠেছে। এরকম পরিবেশ আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। এবারও কোন ব্যাতিক্রম হলাে না। হুতাপাড়া পার হতেই মন কেমন যেন হুহু করে ব্যকুল হয়ে উঠল। | একটা ফাকা জায়গা দেখে গাড়ি থামানাে হলাে। মাঠটা ঘেসে একটা দু'পায়ে মাটির রাস্তা। দেখে মনে হচ্ছে বনের গভীরে চলে গেছে। গাড়ি থেকে নেমেই আড়মােড় ভেঙ্গে রাস্তাটা ধরে হাটা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ হাটতেই দেখলাম একটা শাল কাঠের তৈরী বেঞ্চি। নির্জন জায়গা। অনেকক্ষণ চুপচাপ বেঞ্চিতে বসে রইলাম। কোমল বাতাস। গাছের পাতার খস খস শব্দ। হঠাৎ হঠাৎ পাখির ডাক। আমি অভিভূত। এর কিছুক্ষণ পর খুব কাছে থেকে অস্পষ্ট ভাবে নারী-পুরুষের চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পেলাম। সেই অস্পষ্ট শব্দের মধ্যে স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে হিংসা আর ভয়। | পিছনে ফিরে তাকালাম, দেখি- স্বামি স্ত্রীর মাঝে খুব ঝগড়া হচ্ছে। তাদের দেখে মনে হলাে দরিদ্র পরিবার। কিছুক্ষণ কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম খুব সামান্য বিষয় নিয়ে লেগেছে। সন্ধ্যা বেলার দৃশ্য। একটা দোকানে বসে চা খাচ্ছি। এই জায়গাটাও নির্জন। প্রাচীন একটা আম গাছের নীচে দোকান। আমার সামনে একজন দম্পত্তিও চা খাচ্ছে। মনে হচ্ছে নতুন বিয়ে করেছে। অভিজাত পরিবারই মনে হচ্ছে। চা খেতে খেতে তাদের দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হলাে। এক পর্যায়ে তমুল ভাবে বেজে গেলাে। যুবক চায়ের কাপ খুট করে রেখে বলল, এখানে আর না । গাড়িতে উঠব। মেয়েটি ভেজা ভেজা কন্ঠে ভিতর থেকে একটা অভিমান নিয়ে বলল, তােমার গাড়িতে! একজন ছােট লােকের গাড়িতে আর না। এর এক মাস পর একটা নির্জন জাগায় বসে আছি। এই দৃশ্য দুটি হটাত চোখের সামনে ভেসে উঠলাে। অবচেতন মনে এতটা গভীর ভাবে রেখাপাত করে আছে বুঝতেও পারিনি। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাথার ভেতর খুট করে একটা গল্পও ঢুকে গেল। | এই হলাে উপন্যাস সুখের গহিনে শােক লেখার ইতিহাস। একটা লেখা যখন আমার মধ্যে আসে তখন মাথায় শুধু ঐ গল্পটাই ঘুরতে থাকে। যখন গল্পটা সম্পূর্ণ লিখে ফেলি, তখন মনে হয় মাথা পাতলা হয়ে গেছে। এই উপন্যাসটা শেষ করে নিজেকে নিজেই ধন্যবাদ দিয়েছি। অদ্ভুত আশ্চর্যভাবে আমরা সবাই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। স্পষ্টভাবেই এর কারণ আমাদের জানা আছে। আমরা ইচ্ছে করলেই এর থেকে দূরে সরে যেতে পারিনা। মৃত্যুই আমাদের এক নতুন গন্তব্য। এই গন্তব্যের অভিজ্ঞতা আমাদের কারাে জানা নেই। মৃত্যু মানুষকে ভাবিয়ে তুলে। জড়াজীর্ণ আর ক্ষুদ্রতাকে ঝেড়ে ফেলে বৃহত্তমকে সামনে এনে দেয়। আমরা আর কখনােই এই পৃথিবীতে আসবনা। আমাদের নতুনদের জন্য কিছু রেখে যাওয়া পারাটাই আমাদের দায়িত্ব। ছােট ছােট পাওয়া গুলাে আমাদের আনন্দ দিয়ে পৃথিবীর সময়ে স্মৃতিগুলাে ধরে রাখুক। তবুও আমরা ভুল করে বসি। কেউ জেনে করি আবার কেউ অজান্তেই। আর এই ভুলগুলাে এক সময় বৃহত্তের রূপ ধারণ করে। এ থেকে ফিরে আসা যায় না। কখনােই না।
নিশো আল মামুন ১৯৮৬ সালে জামালপুর, বকশিগঞ্জে জন্মগ্রহন করেন। বাবা মোঃ শাহজামাল (যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, ১১নং সেক্টর) এবং মা সুলতানা রাজিয়া। তিনি বাবা-মায়ের কনিষ্ঠ পুত্র। স্ট্র্যাটিজিক ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে যুক্তরাজ্য থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট সম্পন্ন করেছেন।কলেজ জীবন থেকেই মেতে উঠেন গ্রুপ থিয়েটার নিয়ে। অমিমাংসীত সমাপ্তি (প্রকাশকাল ২০১২ সাল) উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তার সাহিত্যজগতে আত্মপ্রকাশ।তিনি ২০১৬ সালে আমরা কুঁড়ি (জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন) সহিত্য সম্মাননা লাভ করেন এবং ২০১৯ সালে পচ্চিমবঙ্গের ‘বাংলা মৈত্রী লেখক সংসদ সাহিত্য সম্মাননা’ লাভ করেন। নিশো আল মামুন এর প্রকাশিত উল্লেখ যোগ্য গ্রন্থের মাঝে রয়েছে অমিমাংসীত সমাপ্তি, ভোরের ঝরা ফুল,জ্যোৎস্নার বিয়ে, নিখিলের নায়ক, বসন্ত দুপুরের নীলাকাশ, গৃহত্যাগী জোছনা, নীল আকাশের নীচে, কছে দূরে,শেষ স্পর্শ, সুখের গহিনে শোক,নীল সপ্ন,জোছনায় ফুল ফুটেছে, মানুষছবি ।