ইসলাম একটি কালজয়ী আদর্শের নাম। অথচ যথার্থ জ্ঞানের অভাবে ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না, এমনকি মুসলমানরা নিজেরাই ইসলাম সম্পর্কে অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিতে পতিত হচ্ছে। তাই আজ সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ইসলামকে যথার্থভাবে জানা, বুঝা ও উপস্থাপন করা। বাংলাদেশের বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, নন্দিত ব্যক্তিত্ব এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব শাহ্ আব্দুল হান্নান এ প্রয়োজনকে সামনে রেখেই দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে সমাজ ও জাতি গঠনে বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর লেখার বিষয়বস্তু খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ । সামাজিক ও রাজনৈতিক আচরণ, অর্থনীতির গতিধারা, জ্ঞানচর্চা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, ন্যায়বিচার, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ইত্যাদি তাঁর লেখালেখির প্রধান উপজীব্য। সমাজ বিনির্মাণে নারীদের অবদান অনস্বীকার্য এবং ইসলামেও নারীর যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিষয়টি লেখকের কলম এড়িয়ে যায়নি। নারীর ক্ষমতায়ন ও ক্ষমতার পরিসর, সমাজে ও সম্পদে তাদের অধিকার, দায়িত্ব ও মর্যাদা সংক্রান্ত তার লেখনিগুলো অত্র গ্রন্থে গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। এছাড়া তিনি শ্রমিকের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠাসহ সুবিধাবঞ্চিত (Underprivileged) জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে নিয়মিত কলমযুদ্ধ চালিয়ে প্রকৃত মানবতাবাদী লেখক হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন। লেখকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তিনি তৃণমূল থেকে আন্তর্জাতিক সব প্রসঙ্গই সহজ ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। একটি উন্নত সমাজ ও ইসলামি জীবনদর্শনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি নিয়মিত প্রত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেন এবং জনস্বার্থে বিনামূল্যে তা বিতরণ করেন। জাতি গঠনমূলক ও বিষয় বৈচিত্রে অনন্য এ সব প্রবন্ধসমূহ গ্রন্থবদ্ধ করা সময়ের দাবি। ২০১৭ সাল পর্যন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর বাছাইকৃত লেখা প্রবন্ধসমূহ নিয়ে সংকলিত গ্রন্থই হলো ‘উন্নত চিন্তা-মহৎ জীবন- আদর্শ সমাজ'। গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে উৎকর্ষ ও জীবনমুখী জ্ঞানচর্চার একটি ভালো উৎস হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্যও গ্রন্থটি রেফারেন্স হিসেবে কাজে আসবে।
শাহ্ আবদুল হান্নান কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলাধীন কুড়িখাই গ্রামের ঐতিহ্যবাহী শাহ্ পরিবারে ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ শাহ্ সামসুদ্দিন বোখারী (রহ:) সিলেটের হযরত শাহজালাল (রহ:)-এর সহকর্মী ছিলেন । শাহ্ আবদুল হান্নান ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ১ম স্থানসহ মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্র জীবনেই Muslim News International, Karachi, Pakistan-এর ঢাকা প্রতিনিধি হিসেবে সাংবাদিকতায় তাঁর হাতে খড়ি । কলেজের প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও কিছুদিন পর অর্থাৎ ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে দ্বিতীয় সচিব হিসেবে প্রথম যোগদান করেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই এর প্রথম সচিবের দায়িত্ব পান। অর্থ বিভাগ থেকে শুরু করে তিনি শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর বিভাগের কালেক্টর, দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এদেশে যুগান্তকারী মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ব্যবস্থা তাঁর হাত দিয়েই প্রবর্তিত হয়। তাঁর সুদক্ষ কর সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা এবং করভিত্তিক সম্প্রসারণ নীতির বাস্তবায়নের কারণেই আজ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধি পেয়ে দেশ নিজ পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হচ্ছে। সর্বোপরি স্বাধীনতাত্তোর সময়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজানোর পেছনে তাঁর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ১৯৯২ সালে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নিযুক্ত হন। ১৯৯৫ সালে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, ১৯৯৬ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের সচিব এবং ১৯৯৭ সালে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সচিব পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ দেশে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠায় স্বপ্নদ্রষ্ঠাদের একজন তিনি। তিনি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান হিসেবে চার বছর দায়িত্ব পালন করেন । এছাড়াও তিনি Islamic Economics Research Bureau, Central Shariah Board for Islamic Banks in Bangladesh, Islamic Bank Consultative Forum- সহ বহু প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তিনি কিছুদিন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং Bangladesh Institute of Islamic Thought (BIIT)'র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার মাধ্যমে জ্ঞান ও শিক্ষার সংস্কার এবং ইসলামীকরণে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনি দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশন, ইবনে সিনা ট্রাস্ট, বিআইআইটি ট্রাস্ট এবং মানারাত ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হলো Social Laws of Islam, Law Economics and History, My Essays on Socio Political and Islamic Issues, Selected Essays on Islam Politics Economics and Contemporary Issues, Muslim Ummah, Usul-al-Fiqh, Islam and Gender: The Bangladesh Perspective; দেশ সমাজ রাজনীতি, আমার কাল আমার চিন্তা, অষ্টম কলাম, বিশ্ব পরিস্থিতি অর্থনীতি ও ইসলাম, সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি, ইসলামী অর্থনীতি দর্শন ও কর্মকৌশল; নারী ইসলাম ও বাস্তবতা, বিষয়চিন্তা, উন্নত চিন্তা-মহৎ জীবন-আদর্শ সমাজ ইত্যাদি। তাছাড়া তিনি জাতীয় দৈনিকের নিয়মিত কলাম লেখক ছিলেন। সর্বোপরি, মানব সভ্যতার কল্যাণে ও ইসলামি চিন্তার পুণর্গঠনে প্রতিনিয়ত তাঁর লেখনি ও আলোচনার মাধ্যমে তিনি একজন প্রকৃত সমাজ সংস্কারকের ভূমিকা পালন করেছেন ।