ভিন্ন স্বাদের পাঁচটি গল্পের সমাহার ‘জুলু ভাই’। বদিউল আলমের অনবদ্য এক গল্পগ্রন্থ। এই গ্রন্থের ছোটগল্পগুলো মূলত লেখকের জীবনানুভ‚তি ও দৃষ্টিভঙ্গির অনন্য এক রূপায়ণ। যাপিত জীবনে ঘটে যাওয়া নানা অনুষঙ্গকে গল্পে রূপদান করেছেন, যা পাঠ করা মাত্রই অনুধাবন করা যায় ছোটগল্পের তৃপ্তিময় জগৎ। লেখকের নিজস্ব একটা কল্পনার আবহ সেখানে লক্ষ করা যায়। গল্পগুলোর শিরোনামসমূহ তো তাই বলে। যেমন : ১. জুলু ভাই ২. মাসুদের মুক্তিযুদ্ধ ৩. ডালিয়া ৪. আয়েশার স্বপ্ন ৫. গঞ্জের মুটে মূলত জুলু ভাই গল্পটিকে কেন্দ্র করেই এ গ্রন্থের যত আয়োজন। স্মৃতিকাতর একজন মানুষ হিসেবে জুলমত বা জুলু এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। যিনি সমাজ-সংসার ছেড়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন পাহাড়ের ঝর্ণাধারায় বা জলপ্রপাতের পাশে বসে। কিন্তু কেন? ছোট ছোট পাথর কুড়িয়ে এনে জলধারায় ছুড়ে মারেন আর কৈফিয়ত চান আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছিস কেন? দে ফিরিয়ে দে! তিনি কী হারিয়েছেন, কী তার দুঃখ, কী তার সমস্যা! নিরীহ জলধারা কি তা সমাধান করতে পারবে? ‘মাসুদের মুক্তিযুদ্ধ’ গল্পটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ঘটনাবলির সংক্ষিপ্ত রূপ। পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী যখন সারা দেশে অতকির্ত হামলা আর জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে দিয়েছে তখন মাসুদের স্বাদ হয় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে দেশকে মুক্ত করার। কিন্তু সে রকম বয়স তার হয়নি। তবুও যুদ্ধে যাওয়ার অদম্য বাসনা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। নিজ যোগ্যতাবলে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র চালনা শিখে নেয়। প্রত্যাশায় থাকে কবে তার হাতে মেশিনগান আসবে আর মিলিটারি ক্যাম্পটা উড়িয়ে দেবে। ‘ডালিয়া’ গল্পটিও স্মৃতিময় আলেখ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠকালে সম্পর্ক হয় ডালিয়ার সাথে। লেখকের কত কথা, কত স্বপ্ন, কত আশা-আকাক্সক্ষা, কথা-সুরে দিন কাটত তাদের। কিন্তু কী এক অজানা ¯্রােতে হারিয়ে যায় ডালিয়া। এরপর আর কী? ৩২ বছর পর সন্ধান মিলল ডালিয়ার। এ ক্ষেত্রে লেখকের অনুভ‚তি হলো- ডালিয়া হারিয়ে যায়নি, হারিয়েছি আমি নিজেকে। ‘আয়েশার স্বপ্ন’ গল্পে স্বপ্নের জাল বুনেছেন আয়েশা। সলিম মাঝি খর¯্রােতা নদীতে বৈঠা টানার সময় ঘরের ছাউনির ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির পানি বিছানা ভাসিয়ে দেয়। সেই সাথে আয়েশাও ভেসে যায়। ছোট্ট শিশুটিকে শেষ কলেমা পড়ার সময়ও বুকের ওপর শুইয়ে রেখেছিল। মনে তার সাধ ছিল ছেলেকে এমএ পাস দেয়াবে। কিন্তু গরিবের স্বপ্ন কি পূরণ হয়? ‘গঞ্জের মুটে’ গল্পে খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। দিনমজুর সাবেদুলের একটি পা ভেঙে যায়। কাজকর্ম করার শক্তি থাকে না। খবর শুনে তার ছেলে সামিউল গঞ্জের দিকে ছোটে। কিন্তু ছোট্ট সামিউলের পক্ষে কি সম্ভব এই সংকট মোকাবেলা করা? মূলত এ গ্রন্থের গল্পগুলোতে প্রান্তিক মানুষের কথাই লেখক বলতে চেয়েছেন। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাই, টানাপড়েনের সংসার- এ সবকিছুই তার গল্পের উপজীব্য। অহেতুক কিচ্ছা-কাহিনি বাদ দিয়ে লেখক মূলত জীবনের কথাই বলতে চেয়েছেন। যা বোঝা যায় গ্রন্থটি পাঠের মাধ্যমে। সহজ-সরল ভাষায় গল্পগুলো লেখা হয়েছে বলেই তা সম্ভব।
বদিউল আলম। কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। তিনি ১৯৫৬ সালের ৫ মে, চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলায় খাজুরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মরহুম হাজী সেকান্দর আলী মিয়া। মা মোসাম্মৎ ফাতেমা বেগম। কবি বদিউল আলম চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় হতে স্নাতক (সম্মান) ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৮২ সালের বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে যোগদান করেন। মাঠপর্যায়ে কর্মরত থাকাকালে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছেন। সরকারের যুগ্মসচিব পদ থেকে তিনি অবসরে এসে সাহিত্যাঙ্গণে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। নিসর্গপ্রেম, বিরহ, বেদনা, বাস্তবতা, সামাজিক, মনস্তাত্তি¡ক ও মানবিক বিষয়গুলো কবির কবিতায় নান্দনিক এবং সাবলীলভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি একই সঙ্গে কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ জুলুভাই (২০১৯) ও উপন্যাস- ফারু (২০১৯) শাহেদ (২০২০) শেষ উপহার (২০২০) কবরী (২০১২১) দেশে ও বিদেশে বাঙালি পাঠকদের ভূঁয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং আলোচিত ও সমাদৃত হয়েছে। তাঁর কাব্যগ্রন্থ- বলাকার দেশে (২০১৮), কে তুমি তন্দ্রাহরণী (২০১৮), সূর্যাস্তের সাথেই যাব (২০১৯), গোলাপ ছুঁয়েছি নিমগ্ন আবেগে (২০১৯) কবি মহলে ও কবিতাপ্রেমিদের মধ্যে ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছে। ‘শিশিরের ঠোঁটে বেদনার নীল’ তাঁর পঞ্চম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থে তাঁকে পাওয়া যাবে আরও পরিণত ও কাব্যদৃষ্টি সম্পন্ন একজন পরিপূর্ণ কবি রূপে।