"নজরুল উপন্যাস সমগ্র " বইয়ের ভূমিকাঃ তৃতীয় মুদ্রণ] নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে ‘নজরুলের উপন্যাস সংগ্রহ' প্রথম প্রকাশিত হয় আষাঢ়, ১৪০৪ বাংলায়। দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ফাল্গুন, ১৪১৩ (ফেব্রুয়ারি ২০০৭) সালে। দ্বিতীয় সংস্করণের বইও ইতােমধ্যে নিঃশেষ হয়ে গেছে। এবারে আমরা বের করছি নজরুলের উপন্যাস সমগ্র' নামে। এ যাবৎ নজরুলের তিনটি উপন্যাসই আমরা পেয়েছি। বাঁধন-হারা' ১৩৩৪ শ্রাবণ মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এর আগে ১৩২৭ বাংলার বৈশাখ মাসের ১ম বর্ষের ১ম সংখ্যা হতে ‘মােসলেম ভারত'এ ধারাবাহিকভাবে এটি প্রকাশিত হয়। বাঁধন-হারা বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রোপন্যাস। মৃত্যুক্ষুধা' প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৩৩৭ বাংলার বৈশাখ মাসে। '৩৪ বাংলার অগ্রহায়ণ থেকে ৩৬ বাংলার ফাল্গুন সংখ্যা পর্যন্ত সওগাতে’ ধারাবাহিকভাবে এটি প্রকাশিত হয়। কুহেলিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৩৮ বাংলায়। '৩৪ বাংলায় এটি নওরােজ' পত্রিকার আষাঢ় থেকে কয়েক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। নওরােজ বন্ধ হয়ে গেলে সওগাত' বাকী অংশ বের হয়। নজরুলের কবিতা ও গানের পাশাপাশি উপন্যাসগুলাে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। গান ও কবিতায় নজরুলের সমকাল যতটা প্রতীকী, উপন্যাসে তা যেন ততটাই খােলামেলা। সমকালীন রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং মানবিক জাগরণের দিক বড় তাৎপর্যের সঙ্গে এই উপন্যাসগুলােও ওঠে এসেছে। নজরুলের কালে শরৎচন্দ্র সামাজিক বাস্তবতার পটভূমিতে উপন্যাস লিখে খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা দুই-ই পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলােও নানা কারণে বহুল আলােচিত। নজরুল সমাজ রাষ্ট্র এবং ব্যক্তিক জীবনের মানবিক মূল্যবােধ এবং উন্নয়ন সূচকগুলােকে অবলম্বন করে উপন্যাসের কাঠামাে নির্মাণে অগ্রসর হয়েছেন। স্নেহ, মায়া, প্রেম, ভালােবাসা, দুঃখ-কষ্ট, শােক-বিরহ এসব তার পাত্র-পাত্রীর জীবনে এসেছে স্বাভাবিক ও সহজভাবে। রাজনীতি, দেশপ্রেম, স্বাধিকার আন্দোলন, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক উপলব্ধির মধ্যে তিনি যেন তাঁর উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীর জীবনের নানা হিসাব-নিকাশ মেলাতে চেয়েছেন। উচ্চমার্গের তাত্ত্বিক বক্তব্য তিনি দিতে চান নি এগুলােয়, কিন্তু তার পারিপার্শ্বিকতা এবং সমকালীন রাষ্ট্রীয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক যন্ত্রণাগুলাে জল হাওয়ার মতােই স্বাভাবিকভাবে ঢুকে প্লবিত করে দিয়ে গেছে উপন্যাসের পুরাে পরিমণ্ডলকে। তাতে সিক্ত ও অবগাহিত সাধারণ পাঠক একাত্ম হয়ে গেছেন পাত্র-পাত্রীর আন্দোলন-সংগ্রাম ও সুখ-দুঃখের। সাধারণ পাঠকদের কাছে নজরুলের উপন্যাসের গ্রহণযােগ্যতা এ কারণেই বেশি।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী, সুরকার ও প্রবন্ধকার। নজরুলের বাল্যকাল কেটেছে দুঃখ-দুর্দশায়। তাই তাঁর ডাকনাম ছিলো দুখু মিয়া। তাঁর বৈচিত্র্যময় শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের মক্তবে। পিতৃহীন হওয়ার পর তিনি পড়ালেখা ছেড়ে যোগ দেন লেটোর দলে, যেখান থেকে তিনি কবিতা ও গান রচনার কৌশল রপ্ত করেন। পরবর্তীতে এক বছর ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাই স্কুলে পড়ে পুনরায় চুরুলিয়ায় রানীগঞ্জের শিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন, এবং সেখানে তিন বছর অধ্যয়ন করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার আগেই তাকে পড়ালেখা ছাড়তে হয় যুদ্ধে যোগদানের জন্য। যুদ্ধের দিনগুলোতে নানা জায়গায় অবস্থান করলেও তার করাচির সৈনিকজীবনই উল্লেখযোগ্য, কেননা সেসময়েই তার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ নামক গল্প প্রকাশের মাধ্যমে। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমূহ’র বিষয়বস্তু বিবিধ। তবে কাজী নজরুল ইসলাম এর বই-এ সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণা এবং সাম্যবাদের ধারণা প্রকটভাবে স্থান করে নিয়েছে। রাবীন্দ্রিক যুগে তার সাহিত্য প্রতিভা উন্মোচিত হলেও তার সৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমগ্র এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘রিক্তের বেদন’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘প্রলয়শিখা’ ইত্যাদি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নজরুল ‘সাপ্তাহিক লাঙল’, দ্বিসাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’র সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।