“শেখ মুজিব থেকে জাতির পিতা" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ অনেকে বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শতাব্দীর মহানায়ক, কেউ বলেন তিনি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। আমার মতে, তিনি হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী। কেননা তিনিই বাঙালীদের এমন এক রাষ্ট্র উপহার দিলেন যার ভিত্তি হচ্ছে সত্যতা, সমতা ও মানবিকতা। নিশ্চয়ই বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত করতে ন’মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের প্রয়ােজন হয়েছিল কিন্তু তার আদর্শিক ভিত্তি তথা বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বাঙালীর উপলব্দি ও চেতনায় প্রথিতকরণে দীর্ঘ পথ পরিক্রমার প্রয়ােজন ছিল। ন’মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের বহু কারণ রয়েছে। অন্যতম কারণ হচ্ছে বাঙালীর এক জাতীয় উপলব্দি যে পাকিস্তান কাঠামােতে তাদের বহু কাঙ্খিত ও লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন অসম্ভব। স্বাধীনতা ও মুক্তি বাঙালীর বাঞ্ছিত ও কাঙ্খিত হলেও বঙ্গবন্ধুর লক্ষাভিমুখী ও কৌশলী নেতৃত্বই এটাকে বাস্তবায়িত করেছে। পাকিস্তান অর্জনের আগেও বাঙালীর দেশ বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রচেষ্টা দৃশ্যমান ছিল কিন্তু বহুমুখী চক্রান্তের কারণে তা ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট অলীক স্বপ্ন বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই বাঙালীর রাষ্ট্রচিন্তা প্রসারের উদ্দেশ্যমূলক পরিস্থিতি উন্মােচন হতে থাকে। ১৯৪৮ সালে ক্ষীণভাবে এবং ১৯৫২ সালে সরবে স্বায়ত্বশাসন বা স্বাধিকার দাবী উচ্চারিত হয়। ১৯৫৪ সালে নির্বাচন পরবর্তী বাস্তবতার আলােকে ১৯৬১ সালের দিকে এটাই স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হতে শুরু করে যা ১৯৭১ সালে এসে যৌক্তিক পরিণতি লাভ করে। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অনেকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও শেখ মুজিবের অনন্য নেতৃত্বই বাঙালীর আশা-আকাঙ্খকে সর্বাধিক বাজয় করে তােলে। নিজের আকাঙ্খ ও আকুতিকে ১৯৭১ সালের মার্চে তিনি ৫৪ হাজার বর্গমাইল ভূখন্ডের সকল মানুষের সাধারণ আকাঙ্খ ও আকুতিতে পরিণত করেন। বস্তুত: ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ থেকেই তিনি জাতির পিতা হিসাবে অভিহিত হন। স্বাভাবিক যে তিনি একদিনে জাতির পিতা হননি। জীবনের পথ চলতে তিনি কারাে কাছে ছিলেন খােকা মিয়া, কারাে কাছে মুজিব, কারাে কাছে মুজিব ভাই, কারাে কাছে। স্রেফ শেখ সাহেব। এই শেখ সাহেবই ৬ দফা পেশের পর বঙ্গশার্দুল হিসাবে পরিচিতি পেলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসাবে মৃত্যুর দোর গড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। এই মামলা থেকে বেকসুর খালাস পেয়ে ১৯৬৯ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত হলেন আর ১৯৭১ সালে তিনি হলেন জাতির পিতা। এই বাস্তবতার পাশাপাশি আরও একটি রূঢ় বাস্তবতা রয়েছে। মুজিব যখন দশের একজন ছিলেন তখনও তিনি যেমন নন্দিত ছিলেন, তেমনি প্রতিপক্ষের ভিত্তিহীন নিন্দাবানেও জর্জরিত হয়েছেন। ৭৫ সাল থেকে প্রায় ২১ বছর যাবত প্রকাশ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যম বিশেষতঃ সরকার নিয়ন্ত্রিত ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মাধ্যমে কুচক্রী মহল বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে মুছে ফেলতে গিয়ে মুজিব ও মুজিবাদর্শকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। তারই সম্পূরক বা পরিপূরক। হিসাবে তারা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘােষণা ও তৎপরবর্তী বন্দীজীবন এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব, জাতির পিতা প্রসঙ্গ, ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি, বাকশাল গঠনসহ ইত্যাকার বিষয়াদি নিয়ে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন প্রপাগান্ডা চালিয়েছে। তবে সময়ে-অসময়ে যে নেতা মুজিব, পিতা মুজিব, বন্ধু মুজিব, মানুষ মুজিবকে কিঞ্চিতকর করার প্রচেষ্টা তার ভক্ত অনুরক্তরা প্রতিহত করেছে এই গ্রন্থের প্রবন্ধ বা নিবন্ধগুলাে সেই স্বাক্ষর বহন করছে। পরিকল্পিত মিথ্যাচার ও ইতিহাস বিকৃতি রােধের সাময়িক প্রয়াসের অংশ হিসেবে দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিকগুলােতে প্রকাশিত অধিকাংশ লেখাগুলাে নিয়ে এ গ্রন্থ।