"প্রিয়তীর আয়না" বইটির মুখবন্ধ থেকে নেয়াঃ মাকসুদা আখতার প্রিয়তী’র অসাধারণ জীবনের অভিজ্ঞতার কাহিনি ‘প্রিয়তীর আয়না' অন্য আট দশটা বাঙালি নারীদের জীবনকাহিনির মতাে মােটেই সাদামাটা নয়। কারণ যখন আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী লিও ভারাদকার তাঁর ৪০ তম জন্মদিনে বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রিয়তীকে আমন্ত্রণ করেন, তখন বুঝতে হবে আইরিশ সমাজে প্রিয়তীর গুরুত্ব কতটুকু। মাত্র ৩৮ বছর বয়েসে লিও ভারাদকার দেশটির প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, এখন যখন ব্রিটেন ইউরােপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনায় ব্যস্ত তখন একমাত্র ব্রিটিশ দীপপুঞ্জের দেশ আয়ারল্যান্ডের ভূমিকা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ সেটাই আইরিশ প্রধানমন্ত্রী ব্যাখ্যা করছিলেন সম্প্রতি তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। আর সেই জন্মদিনের অনুষ্ঠানে একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী এক আইরিশ। সুন্দরী, দ্বিতীয় সারিতে বসে মনােযােগ দিয়ে শুনছিল আর গম্ভীরভাবে অনুধাবন করছিল আইরিশ প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলাে। হ্যা তিনিই হলেন ‘মিস আয়ারল্যান্ড ২০১৪', মাকসুদা আখতার প্রিয়তী, বাংলাদেশি বংশােদ্ভূত আইরিশ নাগরিক। সেদিনের তার একাগ্র দৃষ্টিতে জন্মদিনের সন্ধ্যায় মনােযােগী দৃষ্টিটি দেখেই বুঝেছি তার সাফল্যের অন্তর্নিহিত কাহিনি কোথায় লুকিয়ে আছে। একজন মিস আয়ারল্যান্ড, মাকসুদা আখতার প্রিয়তী’র সাফল্যের সাথে সাথে অনেক ছােট্ট ছােট্ট হতাশাব্যঞ্জক কালাে অধ্যায়গুলাে থেকে জোনাকীর আলাের মতাে জ্বলে ওঠার বিন্দু বিন্দু স্বপ্ন পূরণ থেকে বাংলাদেশি নারীরাই আশাবাদী হতে পারেন। সবচেয়ে বেশি। তবে হতাশার কাহিনি পরে, আগে তার সাফল্যের কথা বলি। অল্প বয়েসে বাংলাদেশ থেকে একাই ইউরােপের এই দেশটিতে এসে সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্ব নিজ হাতে নিয়েই স্কুল জীবন শুরু করে প্রিয়তী। স্কুল শেষ করে বিজনেস ম্যানেজম্যান্টে অনার্স পড়া অবস্থায় একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরিটাও পেয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি, সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে প্রিয়তী, কিন্তু ভাগ্যদেবী বেশি দিন সহায়ক হয়নি, ২০০৮ সালে মা’র মৃত্যুর সময় বাংলাদেশে এসে নির্ধারিত ছুটির চেয়েও বাড়তি কিছু সময় কাটাতে হয়, তারপরেই নেমে আসে প্রথম বিপর্যয়, রাজধানী ডাবলিনে ফিরে এসে চাকরিটা আর ধরে রাখতে পারেনি প্রিয়তী। শুরু হয় আবার জীবনসংগ্রাম, এরই মাঝে পারিবারিক অশান্তি, পার্টনারের সাথে ছাড়াছাড়ি। দুটি ছােট্ট সন্তান নিয়ে সিঙ্গেল মা’ প্রিয়তী শুরু করে এবার তার সবচাইতে চ্যালেঞ্জিং এক অধ্যায়। এক বন্ধুর পরামর্শে আয়ারল্যান্ডে শুরু করে বিমান চালানাের কোর্স, দেশের তার বাবার জমিটা বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে দু’বছর ধরে শেখে বিমান চালানাে, ২০১২ সালে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পাইলট ট্রেইনিং শুরু করেন আর শেষ করেন ২০১৪ সালে কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স। এর পরেই শুরু হয় প্রিয়তীর দ্বিতীয় সাফল্য, এবারের কর্মক্ষেত্র এভিয়েশন স্কুলে ‘ট্রেনিং পাইলট ইন্সট্রাক্টর’ কথায় আছে ‘সুন্দর মুখশ্রীর জয় সর্বত্র' আয়নায় আবিষ্কার করে নিজের নিখুঁত শারীরিক গড়ন আর সুশ্রী চেহারা, নেহায়েত কৌতূহলের ছলেই মিস আয়ারল্যান্ড প্রতিযােগিতায় অংশগ্রহণের জন্যে আবেদন করে। যথারীতি আমন্ত্রণও পায়। সর্বমােট ৭০০ প্রতিযােগিদের মধ্যে মাকসুদা আখতার প্রিয়তী’র মাথায় বিজয়ের মুকুটটি পরিয়ে দিয়ে জুরি বাের্ড ঘােষণা করে ‘মিস আয়ারল্যান্ড ২০১৪'। এরপর কেটে যায় আরাে কয়েকটি বছর, ২০১৭ সালে শুরু হয় বিশ্বব্যাপী নারী আন্দোলন #MeToo তারানা বার্ক নামে এক কালাে নারী, ব্রোঞ্জ, নিউইয়র্কের বাসিন্দা যৌন নির্যাতনের শিকার হন ছােটোবেলায়, এবং তিনি মিডিয়াতে তা প্রকাশ করেন, তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানাে সােসাল মিডিয়াতে হ্যাস্ট্যাগ #MeToo আন্দোলন শুরু করে হলিউডের বিত্তশালী এক প্রযােজক হার্ভে ওয়েইনস্টাইনের বিরুদ্ধে। শুরু হয় প্রচণ্ড প্রতিবাদ, নারী যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে। হলিউডের ‘অস্কার অনুষ্ঠান, বলিউড, কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালসহ সকল আন্তর্জাতিক ফেস্টিভ্যালে চলে সারাটা বছর প্রতিবাদ। মাকসুদা আখতার প্রিয়তী’র জীবনেও এমন একটি কালাে আধ্যায় বেশ কয়েক বছর থেকেই লুকায়িত ছিল। বাঙালি সমাজে মেয়েরা ভাবেন এসব কথা বলতে নেই, এসব ভুলে থাকাই শ্রেয় বলেন সমাজের ধর্মীয় গুরুরা, কিন্তু প্রিয়তী, ভুলে থাকার মানুষ না। প্রকাশ করে দেন সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে #MeToo হ্যাসট্যাগ তার সামাজিক যােগাযােগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে। তিনিই প্রথম বাঙালি নারী যিনি যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ জানিয়ে মুখ খুলেছেন, মিস আয়ারল্যান্ডখ্যাত বাংলাদেশি বংশােদ্ভূত মডেল ও অভিনেত্রী মাকসুদা আখতার প্রিয়তী। ২০১৫ সালের কথা, তখন তিনি সবে মিস আয়ারল্যান্ড খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। সে সময় ঢাকার এক ব্যবসায়ী তার ওপর যৌন নির্যাতন চালান বলে অভিযােগ এনেছেন প্রিয়তি। অসম্ভব সাহসী এই নারী বৈমানিক, ফিল্ম স্টার, বাংলাদেশের আধুনিক নারী আন্দোলনের পুরােধা মাকসুদা আখতার প্রিয়তী তার জীবনকাহিনি ‘প্রিয়তীর আয়না'।