শুধু দস্তুরমত একটা বিস্ময়কর ঘটনাই নয়, রীতিমত এক সংঘটন। চোর ডাকাত বংশের ছেলে হঠাৎ কবি হইয়া গেল। নজির অবশ্য আছে বটে, দৈত্যকুলে প্রহাদ। কিন্তু সেটা ভগবৎ-লীলার অঙ্গ। মুককে যিনি বাচালে পরিণত করেন, পঙ্গু যাঁহার ইচ্ছায় গিরি লঙ্ঘন করিতে পারে, সেই পরমানন্দ মাধবের ইচ্ছায় দৈত্যকুলে প্রহ্লাদের জন্ম সম্ভবপর হইয়াছিল; রামায়নের কবি বাল্মীকি ডাকাত ছিলেন বটে, তবে তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণের ছেলে। সেও ভগবৎ-লীলা। কিন্তু কুখ্যাত অপরাধপ্রবণ ডোমবংশজাত সন্তানের অকস্মাৎ কবিরূপে আত্মপ্রকাশকে ভগবৎ-লীলা বলা যায় কি না। সে বিষয়ে কোনো শাস্ত্রীয় নজির নাই। বলিতে গেলে গা ছমছম করে। সুতরাং এটাকে লোকে একটা বিস্ময় বলিয়াই মানিয়া লইল এবং বিস্মিতও হইল গ্রামের ভদ্রজনেরা সত্যই বলিল-এ একটা বিস্ময়! রীতিমত! অশিক্ষিত হরিজনরা বলিল-নেতাইচরণ তাক্ লাগিয়ে দিলে রে বাবা! যে বংশে নিতাইচরণের জন্ম, সে বংশটি হিন্দু সমাজের প্রায় পতিততম স্তরের অন্তর্গত ডোমবংশ, তবে শহর অঞ্চলে ডোম বলিতে যে স্তরকে বুঝায় ইহারা সে স্তরের নয়। এ ডোমেরা বাংলার বিখ্যাত লাঠিয়াল-প্রাচীনকাল হইতেই বাহুবলের জন্য ইহারা ইতিহাসবিখ্যাত। ইহাদের উপাধি হইল বীরবংশী। নবাবী পল্টনে নাকি একদা বীরবংশীরা বীরত্বে বিখ্যাত ছিল। কোম্পানির আমলে নবাবী আশ্রয়চ্যুত হইয়া দুর্ধর্ষ যুদ্ধব্যবসায়ীর দল পরিণত হয় ডাকাতে।
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় বিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ছিলেন। ১৮৯৮ সালের ২৪ জুলাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় তাঁর জন্ম। তাঁর শৈশব কাটে এই বীরভূম জেলারই লাভপুর গ্রামে। ধর্মপরায়ণ ও আদর্শনিষ্ঠ বাবা-মায়ের কাছে তিনিও একই সততা ও আদর্শের শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন। লাভপুরের যাদবলাল হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। তবে নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম শেষ করতে পারেননি। ভারতীয় স্বাধীনতা বিপ্লবের সময় রাজনৈতিক কারণে কারাভোগ করতে হয় তাঁর। মুক্তি পাওয়ার পর সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন পুরোপুরি। তাঁর অনন্য প্রতিভায় জন্ম নিয়েছে একেকটি অসাধারণ পাঠকনন্দিত সাহিত্যকর্ম। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় রচনাবলী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সমৃদ্ধ সম্পদ। তাঁর লেখা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের জীবনকে এককভাবে উপস্থাপন করে না, ফুটিয়ে তোলে গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের সব বৈশিষ্ট্যকে। সাহিত্য সৃষ্টি করতে তিনি বাদ রাখেননি কোনো শাখা। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হলো ‘চৈতালি ঘূর্ণি (১৯৩২)’, ‘পাষাণপুরী (১৯৩৩)’, ’ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯)’, ’কালিন্দী (১৯৪০)’, ’কবি (১৯৪৪)’, ’হাসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৫১)’, ‘কালরাত্রি (১৯৭০)’ ইত্যাদি। তারাশঙ্করের উপন্যাস সমগ্র সংখ্যার হিসাবে প্রায় ৬৫টি। এর মধ্যে ‘কবি’ উপন্যাসটি তারাশঙ্করের কালজয়ী উপন্যাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামার মাঝে তিনি বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী ও সাহিত্য সম্মেলন এর নেতৃত্ব দান ও সভাপতিত্ব করেন। পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবে তিনি আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় কবিতা সমগ্র হল ‘ত্রিপত্র (১৯২৬)। এছাড়াও সাহিত্য রচনা করেছেন ছোটগল্প, নাটক, প্রহসন ও প্রবন্ধ আকারেও। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ছোটগল্প সংকলন হলো ‘ছলনাময়ী (১৯৩৭)’, ‘রসকলি (১৯৩৯)’, ‘হারানো সুর (১৯৪৫)’, ‘কালান্তর (১৯৫৬), ‘মিছিল (১৯৬৯)’, ‘উনিশশো একাত্তর (১৯৭১)’ ইত্যাদি। তাঁর রচিত অনেক উপন্যাস পেয়েছে চলচ্চিত্র রূপ, এদের মাঝে আছে ‘কালিন্দী’, ‘দুই পুরুষ’, ‘জলসাঘর’, ‘অভিযান’। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় উপন্যাস সমগ্র বাঙালি পাঠকের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘শরতস্মৃতি পুরস্কার (১৯৪৭)’, ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক (১৯৫৬)’, ‘রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৫৫)’, ‘পদ্মশ্রী (১৯৬২)’, ‘পদ্মভূষণ (১৯৬৮)’ ইত্যাদি পুরস্কার ও উপাধি লাভ করেন। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় এর বই সমূহ মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছে। পাঠকনন্দিত এই বাঙালি কথাসাহিত্যিক ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পরলোকগমন করেন।