"গৃহদাহ" বইয়ের সংক্ষিপ্ত লেখা: শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শিল্প সার্থক উপন্যাসটি হলো ‘গৃহদাহ’। মানুষের ভেতরের অন্ধকার স্তরের গোপন প্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এ উপন্যাসে। স্থান, কাল বড় হয়ে ওঠেনি, পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এবং ঘটনায় যে আলোড়ন তা উপন্যাসকে গতিশীল করেছে। জৈবিক প্রবৃত্তির দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা মানুষকে কতটুকু স্বার্থ পর করে তোলে তার বিবরণ উঠে এসেছে এ উপন্যাসে। ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনি ‘গৃহদাহ’ উপন্যাস। উপন্যাসের মূল উপজীব্যই প্রেম। আর প্রেমের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেছে রহস্যময়ী নারী অচলা। তাকে ঘিরে যে দুই প্ররুষ আবর্তিত হয়েছে তারা হলো মহিম ও সুরেশ। বলা হয়ে থাকে অচলার দোলাচলবৃত্তিই ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসের প্রাণ। অচলা মহিমকে ভালোবাসলেও সুরেশের প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছিল। এর মূলে যতটুকু না প্রেম তারচেয়েও অধিক তার স্নেহশীল করুণ হৃদয়। অচলার পিতার অর্থ লিপ্সার কারণে অচলা অনেকটা বাধ্য হয়েছিল সুরেশের প্রতি চোখ ফেরাতে। কিন্তু ব্রাহ্ম সমাজের উদার সংস্কার শিক্ষা দীক্ষায় দীক্ষিত অচলা মহিমকে বিয়ে করে পরপুরুষ সুরেশ বাবুর সঙ্গে সম্পর্ক ইচ্ছে করে রাখেনি। আসলে ঘটনা পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। তার ভেতরেও ভারতীয় নারীর সংস্কার ছিল। কিন্তু অজ্ঞতার কারণেই হোক বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক সে তা হারিয়ে ফেলেছে। মনস্তত্ত্বের বিচারে ‘গৃহদাহ’ উৎকর্ষে উত্তীর্ণ । এর নিখুঁত গঠন কৌশল ‘গৃহদাহ’কে সেই্ মহিমা দান করেছে।
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।