"চলচ্চিত্র নন্দনতত্ত্ব ও বারোজন ডিরেক্টর" বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: কেন বারাে? কেন নয় এগারাে বা তেরাে? হয়তাে ওই পুরনাে ইংরেজী প্রবাদটি “ডজনে সস্তা পড়ে” বারােজন পরিচালকের ভেতরেই আলােচনা সীমিত রাখার কারণ ঘটিয়েছে। ছাপা ও কাগজের আকাশচুম্বী দামের কারণে বইটির মূল্যকে পাঠকের নাগালে রাখার উদ্দেশ্যটা ছিল মনে। আর সে কারণেই অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বুনুয়েল, ড্রেয়ার, ফ্রিজ ল্যাঙ বা ক্রুফোকে প্রথম খন্ডে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলাম না। ইচ্ছে আছে আরাে বারােজন নিয়ে দ্বিতীয় খন্ড রচনার সময় এদেরকে অন্তর্ভুক্ত করার। পরিচালকদের তালিকায় এক নজর তাকালেই বােঝা যাবে যে জনপ্রিয়তা বা খ্যাতি প্রধান গুরুত্ব পায়নি। তাহলে স্ট্রোহাইম হয়তাে বারাে জনের একজন হতে পারতেন না। কিম্বা কুলেশভও। আসলে যে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিতে চেয়েছি তা হচ্ছে বিশ্ব-চলচ্চিত্রের কারিগরী ও নান্দনিক ক্ষেত্রে পরিচালক হিসেবে কোনাে মৌলিক অবদান। চলচ্চিত্র নন্দনতত্ত্বে এই প্রত্যক্ষ অবদানের কারণেই গ্রিফিথ, রেনে ক্লেয়ার বা ফ্লাহার্টি সহজেই এসে পড়েছেন। খুবই খুশী হতাম ইতালীয় নিওরিয়ালিস্ট কাউকে, ডি সিকা বা রসেলিনীকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে, কিন্তু ওই বারাের বাঁধনের কারণেই সে ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারলাম না। ওই একই কারণেই বাইরে রয়ে গেলেন কুরােশাওয়া ও আমাদের পাঠকসমাজের কাছে অনেক বেশী পরিচিত ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেন। ব্যক্তিগত জীবনে সমাজসচেতন শিল্পে বিশ্বাস করি। ফলে একজন চলচ্চিত্রকার বা যে কোন একজন শিল্পীর সমাজ ও রাজনীতিসচেতনতা আমার কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আর সে কারণেই এসব পরিচালকের মূল্যায়নে সমাজসচেতনতার দৃষ্টিভঙ্গিটাই প্রাধান্য পেয়েছে। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের লাইব্রেরী ব্যবহার করার সুযােগ দান করার জন্য এই দুই পাঠাগারের কর্তৃপক্ষের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বন্ধুবর মানজারে হাসান মুরাদ ওঁর ব্যক্তিগত চলচ্চিত্র বইয়ের সংগ্রহ ও পত্রপত্রিকা দিয়ে বিভিন্ন সময়ে অপার সাহায্য করেছেন। স্বল্প সময়ে প্রথম দু'টি সংস্করণ নিশেষ হওয়াতে ভাল লেগেছিল এই উপলব্ধিতে যে এদেশে চলচ্চিত্র বিষয়ক মননশীল রচনার পাঠকের কমতি তেমন নেই। তবে নানা কারণে বইটির নতুন কোনাে সংস্করণ বাজারে ছিল না। নতুন এই সংস্করণে তেমন কোনাে সংযােজন বা বিয়ােজন থেকে বিরত রইলাম। যেটুকু পরিবর্তন এখানে-ওখানে তা মূলত: ভাষাগত, বিষয়গত নয়। বইটি নতুন করে প্রকাশের জন্যে “অনার্য পাবলিকেশন্স লি.” প্রকাশনার সফিক রহমানের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। বইটি যদি এদেশে শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র চর্চার ক্ষেত্রে সুরুচি ও মননশীলতার বিকাশে যৎসামান্যও অবদান রাখে তাহলেই এ পরিশ্রমটুকু সফল হয়েছে বলে মনে করব।
দেশে-বিদেশে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে পরিচিতি আছে তানভীর মােকাম্মেলের। সে পরিচিতি এই উপমহাদেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও । ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র তানভীর মােকাম্মেল চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি নিয়মিত লেখালিখিও করে থাকেন। প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, সব ধরনের লেখাতেই সিদ্ধহস্ত তিনি। সম্প্রতি উপন্যাস লেখা। শুরু করেছেন। গত বছর প্রকাশিত ওঁর “দুই নগর” উপন্যাসটি পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়েছে। ওঁর দ্বিতীয় উপন্যাস “কীর্তিনাশা” সাতচল্লিশের দেশভাগ ও বিক্রমপুর অঞ্চলকে ঘিরে “নদীর নাম মধুমতী”, “চিত্রা নদীর পারে”, “লালসালু”, “লালন”, “রাবেয়া”, “জীবনঢুলী” এসব ইতিহাসসচেতন চলচ্চিত্রের মতােই তানভীর। মােকাম্মেলের লেখালিখির ধরনটাও ইতিহাসমনস্ক ও মননশীল। ওঁর রচিত গল্প-উপন্যাস ও কবিতায় এমন গভীর একটা সমাজমনস্কতা ও ইতিহাস চেতনা রয়েছে যা ওঁকে বর্তমান সময়ের আর পাঁচজন লেখক থেকে একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। তানভীর মােকাম্মেল এ পর্যন্ত বিশটির মতাে কাহিনী ও প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন, লিখেছেন বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ ও সাহিত্য-সমালােচনামূলক বই, আর লিখেছেন প্রচুর কবিতা । ওঁর নির্মিত চলচ্চিত্রের মতাে ওঁর রচনাগুলােও হয়ে পড়েছে বাংলা নামের এই জনপদের কাল ও সময়ের এক নির্মিতি যা এক বিশেষ সময়কালকে ধারণ করলেও হয়ে উঠেছে কালাতিক্রান্ত। দেশে-বিদেশে অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০১৭ সালে তাকে একুশে পদকে সম্মানিত করা হয়েছে।