"পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি এবং আদিবাসীদের লাভ-ক্ষতি" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তিটি সম্পাদিত হয়। এরপর চুক্তিটির বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। এ সময়ই সন্তু লারমা বড় ভুল করে ফেলেন। তিনি নিজে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী না-হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হন এবং তার সুপারিশে খাগড়াছড়ি জেলার সাংসদ কল্পরঞ্জন চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হন। রাঙামাটি জেলার সাংসদ দীপংকর তালুকদারকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য গঠিত ট্যাক্সফোর্সের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তখন চুক্তিটির সব ধারা বাস্তবায়ন করা খুবই সহজ ছিল। কারণ তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক ছিলেন এবং এ বিষয়ে তার জনসমর্থনও ছিল। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা কল্পরঞ্জন চাকমা চুক্তিটির বাস্তবায়নে মনােযােগ না-দিয়ে তিনি নিজের ভাগ্য উন্নয়নে বেশি মনােযােগী হন। ফলে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ৪ বছর সময় পাওয়া গেলেও চুক্তিটির সব ধারা, বিশেষ করে মূল ধারাগুলাের অবাস্তবায়ন থেকে যায়। এমনকি চুক্তিটির মূল ধারাগুলাের বাস্তবায়নের সূচনাও তখন করা হয়নি। আর দীপংকর তালুকদার ভবিষ্যতে কেমন করে মন্ত্রী হওয়া যাবে কেবল সেই তালেই থাকেন। ফলে ৪ বছরে তিনি কেবল ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের একটি লিস্ট এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের একটি লিস্ট তৈরি করতে সক্ষম হন। তার চেয়েও অবাক কাণ্ড তিনি করে ফেলেন, তিনি জেনারেল জিয়ার আমলে পুনর্বাসনের জন্য আনীত ৪ লাখ বাঙালি শরণার্থীর মধ্যে যাদের নিরাপত্তার স্বার্থে এতদিন বিভিন্ন গুচ্ছগ্রামে রাখা হয়েছিল, তাদের অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসাবে পরিচিহ্নিত করে তাদেরও একটি লিস্ট তৈরি করেন এবং শরণার্থী সমস্যাকে আরাে জটিল করে তােলেন। সেটাকে তিনি একেবারে বদমতলবে করেন। তিনি নিজেকে অত্যন্ত সেকুলার এবং নিরপেক্ষ দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অন্যান্য ক্ষমতাশীলের কাছে নিজের ভাবমূর্তি কল্পরঞ্জনের চেয়েও উজ্জ্বল এবং গ্রহণযােগ্য করতে চেয়েছিলেন। ২০০১ সালের প্রথম দিকে আমি একবার এক মাসের ছুটি নিয়ে ভুটান থেকে ঢাকায় এসেছিলাম। তখন সন্তু লারমাও ঢাকায় ছিলেন। সে সময় আমি তাকে একদিন আমার বাসায় নিমন্ত্রণ করি। তার সঙ্গে প্রখ্যাত লেখক এবং মানবাধিকার কর্মী সালাম আজাদকেও নিমন্ত্রণ করি। তখন আমাদের ৩ জনের মধ্যে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়। আলাপের এক পর্যায়ে সন্তু লারমা আমাকে বলেন— ‘দাদা, আমার জীবনের একটি বড় ভুল হলাে, কল্পরনঞ্জকে মন্ত্রী বানানাে। কল্পরঞ্জনকে মন্ত্রী না করে আপনাকে মন্ত্রী করলে আমার এখন এরকম দুর্দশায় পড়তে হতাে না। তখন আমি তাকে বলি, তােমার উচিত ছিল তােমার নিজেই মন্ত্রী হওয়া। তুমি মন্ত্রী হলে এবং আমি মন্ত্রণালয়ের সচিব হলে চুক্তিটির সব ধারা এতদিনে বাস্তবায়ন হয়ে যেত। শান্তিচুক্তির পর ইতােমধ্যে ১৯ বছর গত হয়েছে। এ ১৯ বছরে দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় মৌলবাদ অনেক বেড়ে গেছে। ফলে চুক্তি বাস্তবায়নের বিরােধিতাও অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে চুক্তি বাস্তবায়ন না-হওয়ায় যারা বেশি beneficiary তাদের বিরােধিতা আরাে বেড়ে গেছে। চুক্তিবিরােধী এই beneficiary. দের ক্ষমতা এমন যে, পার্বত চট্টগ্রামে তারা এখনও যাকে ইচ্ছা তাকে আটক করতে পারে, যাকে ইচ্ছা তাকে পিটিয়ে হত্যা করতে পারে এবং যাকে ইচ্ছা তাকে বাস্তুচ্যুত করতে পারে। যেমন গত ৫ এপ্রিল ২০১৭ সাল তারা রাঙামাটি জেলার নানিয়াচর সরকারি কলেজের ছাত্র এবং নানিয়াচর উপজেলা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অন্ধ রমেল চাকমাকে আটক করে, এরপর তাকে পিটিয়ে গুরুতরভাবে আহত করা হয়। পরদিন তারা রমেল চাকমাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয় এবং ভর্তি করে। ২০ এপ্রিল ২০১৭ রমেল চিকিৎসারত অবস্থার হাসপাতালে মারা যায়। এরপর তার মৃতদেহটিকে তার বাবা-মার কাছে হস্তান্ত র না-করে এবং কোনাে রকম ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া পুড়িয়ে ফেলে। এমন ক্ষমতা কেউ ছাড়তে চায়? তাদের ক্ষমতা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি। কাজেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তাদের বিরােধিতা উপেক্ষা করে, শান্তিচুক্তির মূল ধারাগুলাে এখন বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের এদেশে থাকতে হলে বাঙালি হতে হবে, অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় তাদের দেশত্যাগী হতে হবে। আর তারা ক্রমান্বয়ে দেশ ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। তবে এটা দুঃখের বিষয় আমরা ভিনদেশি রােহিঙ্গাদের বুকে টেনে নিচ্ছি, আর নিজ দেশের আদিবাসীদের অত্যাচার নির্যাতন করে তাড়িয়ে দিচ্ছি, পরবাসী করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রােহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য Mother of Humanity বলছি। আরাে দুঃখের বিষয় দেশের ১৬ কোটি বাঙালি দেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলাে দেখেও না-দেখার ভান করে রয়েছে। এস এস চাকমা
Title
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি এবং আদিবাসীদের লাভ-ক্ষতি