মিডিয়ার মন -বইয়ের কিছু কথা গণমাধ্যম গণমানুষের মাধ্যম। গণমাধ্যমের উদ্দেশ্য জনমানুষকে তথ্য, শিক্ষা, বিনোদন দেয়া এবং প্রভাবিত করা তথা জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনমত তৈরি করা। গণমাধ্যম সমাজের দর্পণ হিসেবে কাজ করে। যা কালো এবং ভালো দুটোই চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, জনগণ বুঝতে পারে, সচেতন হয়। শাসক এবং শোষিতের কণ্ঠকে সমান্তরালে নিয়ে এসে জবাবদিহির ক্ষেত্র তৈরি করে। তাই গণমাধ্যমকে আতশি কাচের মতো সমাজের সকল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সামনে থাকতে হয়। কিন্তু আবার সংবাদ হলো, সেখানে আসল সত্য প্রতিভাত হলো না। গণমাধ্যম যদি কোনো বিষয়ে ফলোআপ না করে বা কোনো অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশে অনাগ্রহী হয়, মূল সত্য কিন্তু চাপা পড়ে যায়। অ্যাডভোকেসি করে গণমাধ্যম একটু সংবেদনশীল হয়ে সত্য বিশ্বাসটাকে জনস্রোতে প্রোথিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু সে কাজটি স্পর্শকাতর। বাচ্চার জন্মের পর তাকে কোলে নেয়ার মতোই কঠিন। আদর করো কিন্তু এমনভাবে যাতে ব্যথা না পায়, কারণ সে তখনো পরিণত হয়নি। একটি সংবাদ যখন তৈরি হয়, তার শরীর থাকে অত্যন্ত সংবেদনশীল। এই সেন্স ঠিক রেখে শব্দ প্রয়োগ করাও তাই গণমাধ্যমের কাজ এবং এটা খুব জটিল। কারণ গণমাধ্যম আজ কতটা গণমাধ্যম, সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ। মালিকানার ধরন, সম্পাদকের গড়ন, বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপ, সাংবাদিকের আচরণ প্রভৃতি বিষয়ে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হওয়ায় গণমাধ্যমের চরিত্র নিয়েও শঙ্কা চলছে, আশঙ্কাও কম নয়। আস্থার সংকটে ভুগছে আজকের গণমাধ্যম। উপরন্তু সরকার, সময় এবং বিশেষ চাপ তো থাকেই। সেক্ষেত্রে সংবাদ বা অন্য যে কোনো বার্তা প্রদানে গণমাধ্যমকে বেশ সজাগ ও সতর্ক থাকতে হয় বৈকি। সিলেটের খাসিয়া নৃ-গোষ্ঠীর সাথে যদি চা-বাগানের মালিকের সমস্যা থাকে, তাহলে সেই মালিকই যদি কোনো গণমাধ্যমের মালিক হন, সেই গণমাধ্যমে খাসিয়া সম্প্রদায়ের সংবাদ হয়ত আসবে কিন্তু কতটা, কীভাবে, কার স্বার্থ রক্ষা করবে বলা একটু মুশকিল নয়? সংবাদকর্মী চাইলেও কি আর সবটুকুু করতে পারবেন ! কিন্তু ইতিহাস বলে যে সভ্যতা এগিয়ে যায়, শুভ বুদ্ধির জয় হয়Ñএটাই নিয়ম। লড়াই টিকে থাকে। সংগ্রাম যোদ্ধাকে আত্মপ্রত্যয়ী করে, আত্মবিশ্বাসী গড়ে। গণমাধ্যমের চরিত্র সেই লড়াইয়ে কতটা টিকে থাকবে, কতটা সত্যাশ্রয়ী ও কৌশলী হবে এসব কিছুর উপরই নির্ভর করবে গণমাধ্যমের জনসম্পৃক্ততা ও জনগণদৃঢ়তা। গণমানুষের লড়াই সংগ্রামে, জীবন-জীবিকায় গণমাধ্যম সংবেদনশীল ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও ত্রাতার ভূমিকাই পালন করবে, প্রত্যাশা । বাংলাদেশে গণমাধ্যম বলতে মুদ্রিত, সম্প্রচার এবং অনলাইন গণমাধ্যমকে বোঝায়। জনগণ কতটা জানবে-শুনবে তা একসময় ঠিক করে দিতেন রাজা ও পুরোহিতবৃন্দ। আর এখন নির্ধারণ করে দেয় গণমাধ্যম। প্রতিদিন গণমাধ্যমই নির্ধারণ করে দিচ্ছে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ খবর, কী হওয়া উচিত আমাদের আড্ডার বিষয় বা রাজনৈতিক আলোচনা। বেন বাগদিকিয়ান বলেন, গণমাধ্যম যা সম্প্রচার করে না, জগতে তা সংগঠিত হয় না। গণমাধ্যম এখন শুধু বাস্তবতার প্রতিফলন নয়, বরং বাস্তবতার উৎস। বাস্তবতা হলো কাগজের মধ্যে খবরের কাগজ চরম সত্য এবং নাগরিক জীবনের সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়ের সর্বাধিকারী। সত্যকে মিথ্যা বা মিথ্যাকে সত্য হিসেবে উপস্থাপনের এই অসাধারণ ক্ষমতা ও দক্ষতা জাদুকরদেরও নেই। কথায় কথায় আজ তাই বাইরে শুনতে হয়, সাংবাদিকেরা সংবাদ জানান না, বরং তারা সংবাদ বানান। বর্তমানে মানুষের তথ্য জানার আগ্রহ বেড়েছে, যার কাছে যত তথ্য, সে তত ক্ষমতাশালী। সবার আগে তথ্যপ্রাপ্তি, বেশি তথ্য জানা এবং প্রযুক্তিবিষয়ক জ্ঞান বর্তমানে ক্ষমতার নির্ধারক। আর তাই, সামজিক মাধ্যমের বদৌলতে মূলধারার মিডিয়া ক্রমশ মানুষের আস্থা হারাচ্ছে। রাজনৈতিক বা অতিমুনাফার উদ্দেশ্যে গণমাধ্যম ব্যবহৃত হওয়ায় তা সমাজের যথার্থ ওয়াচডগের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। এটি স্বাভাবিক যে, প্রতিটি সম্পাদনাই সংবাদের নির্যাস নষ্ট করে। সেক্ষেত্রে গণমাধ্যমের সেল্ফ সেন্সরশিপের কারণেও আমরা সঠিক তথ্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হই। বর্তমানে মিডিয়া তাই জার্নালিজম নয়, সে নিজেই অ্যাকটিভিজমের কাজ করছে। উপরন্তু, উদার গণতান্ত্রিকতার চর্চা না থাকায় দেশি মিডিয়া প্রকৃতপক্ষে শতভাগ নিরপেক্ষ নয়। গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বিনির্মাণের মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নানান ধারার বস্তুনিষ্ঠ স্বাধীন গণমাধ্যমের এই আকাক্সক্ষাকে জিইয়ে রাখার কোনো বিকল্প নেই। মিডিয়ার মন সেই আকাক্সক্ষার রকমফের খুঁজেছে মাত্র। এখানে গণমাধ্যমের নানান দিক নতুনভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। গণমাধ্যমের সঙ্গতি-অসঙ্গতি, ইতিবাচক-নেতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়েছে, যা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, বরং গণমাধ্যমের চলার পথকে মসৃণ করার লক্ষ্যে। ভবিষ্যৎ গণমাধ্যম কেমন হবে তা নিয়ে চিন্তা করতে, ভাবতে বইটি সহায়ক হবে বলে আমরা মনে করি। সব কাজেরই কিছু সীমাদ্ধতা থাকে। এই বইয়ের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। বইতে অনেক সীমাদ্ধতা থাকতে পারে, ভুল হতে পারে। পরের সংস্করণে বইটি আরো পরিমার্জন, পরিবর্ধন করে সমৃদ্ধ করতে সহায়তা করবেন, পাঠকদের কাছে প্রত্যাশা। এই বই লিখতে গিয়ে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি এসেছে, লেখক রাজীব মীরের মৃত্যু। এই বই তাঁর স্বপ্ন, সন্তানসম স্বপ্নের প্রতিফলন। মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও এই বইয়ের তথ্য সমৃদ্ধির ভাবনা তাকে কাতর করেছে। ‘মিডিয়ার মন’ রাজীব মীরের শেষ প্রকাশনা। ২০ জুলাই ২০১৮ লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে বড় অকালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন এই ক্ষ্যাপাটে লেখক। মিডিয়ার মন পাঠকের কাছে মুক্ত গণমাধ্যমের বহুমাত্রিক ধারাকে আরো স্পষ্ট করতে দৃঢ় ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, এই প্রত্যাশা করি। যাঁদের সক্রিয় সহযোগিতা ও আন্তরিক পরামর্শ এই বইটি সম্পন্ন করতে আমাদের প্রেরণা ও প্রণোদনা জুগিয়েছে, তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। বিশেষ করে পলল প্রকাশনীর কর্ণধার খান মাহবুবকে বইমেলার প্রায় শেষ সময়ে বইটি প্রকাশের আগ্রহকে অভিবাদন জানাই। - সাইফুল ইসলাম - কাজী নুসরাত শরমীন