"ডেল কার্ণেগী শ্রেষ্ঠ রচনাসমগ্র" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ ডেল কার্ণেগী-র নাম জানে না কিংবা তার নামের সাথে পরিচয় নেই এমন একজন শিক্ষিত মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। শুধুমাত্র বই লিখেই সাধারণ মানুষের মনে কাজ ও কর্মের অনুপ্রেরণা যােগাতে যে ব্যক্তি সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর নাম ডেল কার্ণেগী। সারা পৃথিবীর অসংখ্য হতাশাগ্রস্থ মানুষের কাছে তিনি হতাশামুক্ত প্রবল বিশ্বাসের পথ প্রদর্শক। বই লেখার মাধ্যমে সর্বস্তরের শিক্ষিত মানুষের হৃদয়ের গভীরে স্থান করে নেয়া সহজ কথা নয়। অথচ ডেল কার্ণেগী সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে দেখিয়েছেন। আজ পৃথিবীর অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার লিখিত বই পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরীতে একজন নিতান্ত সাধারণ মানুষ হিসেবে জীবনযাত্রা শুরু করেন ডেল কার্নেগী। রেলপথের দশ মাইল দূরে এক অখ্যাত্ব খামারবাড়িতে তার জন্ম। তাঁর স্বীকারােক্তিতে জানা যায়, বারাে বছর বয়সের আগে মােটরগাড়ি কাকে বলে তিনি জানতেন না। অথচ নিয়তির কি অপূর্ব লীলাখেলা। তাঁর বয়স ছেচল্লিশ বছর পার না হতেই পৃথিবীর দূর দূর প্রান্তের প্রায় প্রতিটি শিক্ষিত মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯১২ সালে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে অবস্থিত ওয়াই.এম.সি.এ-তে সাধারণ শিক্ষক হিসেবে নিজের পেশা গ্রহণ করেন তিনি। কালক্রমে তার শিক্ষক-জীবনের অবস্থানের ভিত এতােটাই শক্ত হয়ে ওঠে যে, সমাজের অনেক উঁচুস্তরের মানুষও তার মতাে সাধারণ শিক্ষকের ছাত্র হবার জন্যে আগ্রহী হয়ে পড়ে। সে সময় অনেক প্রতিকূলতার বাধা টপকে মানুষের মনের গভীরের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করার জন্যে তিনি লিখে ফেলেন ‘প্রতিপত্তি ও বন্ধু লাভ’ নামের একটি গ্রন্থ। সাধারণ জন মানুষের হৃদয়ে মণিকোঠায় স্থান পাবার জন্যে এবং জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছাতে এই বইটি অভূতপূর্ব ভূমিকা রেখেছে। তিনি এই বইয়ের মাধ্যমে হতাশাগ্রস্থ মানুষের মনের হতাশা দূর করে সত্যিকারের আশার আলাে জ্বালাতে পেরেছিলেন গভীর আস্থার সাথে। লেখার মাধ্যমেই মানুষের মনের ভেতরকার সুপ্ত ক্ষমতাকে জাগ্রত করতে সক্ষম হয়েছেন উনি। তিনি বলেছেন, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অপরিশীম শক্তি আর প্রতিভা। অধিকাংশ মানুষই এটার হদিস জানে না বলে এই শক্তির উপযুক্ত ব্যবহার করতে পারে না। এই অব্যবহৃত শক্তির উন্মেষ ঘটিয়ে নতুন উদ্দীপনায় মানুষের মনের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করতে সহায়তা করেছে তার লেখা বিভিন্ন গ্রন্থাবলী। তাঁর এইসব বই পড়ে কোটি কোটি মানুষ নিজের জীবনে খুঁজে পেয়েছে আত্মবিশ্বাস আর সেই সাথে নিজেদের কর্মশক্তিতে আনতে পেরেছে উন্নতির জোয়ার। হতাশাগ্রস্থ মানুষ পেয়েছে দুশ্চিন্তামুক্ত নতুন জীবনের আস্বাদ। কার্ণেগীর বই মানেই মানুষের জীবনের নানা সমস্যার সহজ-সরল এবং যুক্তিপূর্ণ সমাধান। মানুষের জীবনের বিভিন্ন জটিল সমস্যার সমাধান সুনিপুণ দক্ষতায় যুক্তিপূর্ণ তথ্য দিয়ে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়েছেন ডেল কার্ণেগী। তার বইতে এমন সব মানুষের কথা লিপিবদ্ধ আছে যারা দারিদ্র্যসীমার সর্বনিম্ন স্তর থেকে ধীরে ধীরে উন্নতির চরম শিখরে উঠতে পেরেছেন। ডেল কার্নেগীর রচিত বই পড়ে উপকার পেতে পারেন নানা পেশা আর নানা বয়সের মানুষ। যে কোন পেশায় নিয়ােজিত মানুষের জন্যেই তাঁর বই। দুশ্চিন্তা দূর করে কিভাবে দীর্ঘ আনন্দময় জীবন লাভ করা যায়-সে কথাও যেমন জানা যায় তাঁর বই পড়ে, তেমনি জানা যায় মানুষের কাছে কিভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা যায়।
ডেল ব্রাকেনরিডজ কার্নেগী, এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে ২৪ নভেম্বর, ১৮৮৮ সালে জন্ম নেওয়া এই আমেরিকান লেখক তাঁর আত্ম-উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও বইয়ের পাতায় আজও বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এক নাম। সেলফ-ইম্প্রুভমেন্ট, সেলসম্যানশিপ, করপোরেট ট্রেনিং, পাবলিক স্পিকিং, ও ইন্টার পার্সোনাল স্কিল এর মতো দারুণ সব প্রশিক্ষণের উদ্ভাবন ও এসব বিষয়ে লেখা ডেল কার্নেগী এর বই সমূহ আশার আলো দেখিয়েছে অসংখ্য হতাশাচ্ছন্ন মানুষকে। মিসৌরিতে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়ার দরূণ বালক বয়স থেকেই কাজ করেছেন ক্ষেতখামারে। এর মাঝেও ওয়ারেন্সবার্গের সেন্ট্রাল মিশৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। কলেজ শেষে জীবিকার তাগিদে বেকন, সাবান এবং লার্ড (শূকরের চর্বি মিশ্রিত করা) তৈরির কাজও করতে হয় আর্মর অ্যান্ড কোম্পানির জন্য। ফার্মের প্রধান হিসেবে অনেক সাফল্য লাভ ও ৫০০ ইউএস ডলার সঞ্চয়ের পর ১৯১১ সালে বহুদিনের লালিত স্বপ্ন অধ্যাপক হওয়ার জন্য বিক্রয় সেবার কাজটি ত্যাগ করেন তিনি। কিছু ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা ঝুলিতে নিয়ে যখন ওয়াইএমসিএ- এর ১২৫ নম্বরে বাস করতে শুরু করেন, তখনই পাবলিক স্পিকিং এর ধারণাটি মাথায় খেলা করে কার্নেগীর। সেই সময় মোট লভ্যাংশের ৮০% শতাংশের বিনিময়ে ওয়াইএমসিএ এর পরিচালকের কাছে শিক্ষা প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এভাবেই ১৯১২ সাল থেকে কার্নেগী কোর্সের যাত্রা শুরু হয়। পুরো আমেরিকাবাসীর কাছে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির পথ হয়ে উঠে তার পদ্ধতি। ডেল কার্নেগী এর বই সমগ্র এর মধ্যে ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স’ বইটিকে তার সেরা অবদান হিসেবে ধরা হয়। প্রথম প্রকাশের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই যার ১৭তম মুদ্রণও প্রকাশ করতে হয়েছিলো। ডেল কার্নেগী এর লেখাগুলো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ‘বিক্রয় ও জনসংযোগ প্রতিনিধি হবেন কীভাবে’, ‘বন্ধুত্ব ও সম্পদ লাভের কৌশল’, ‘বড় যদি হতে চাও’, ‘ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও সাফল্যের সহজ পথ’ এমন নানা নামের অনূদিত ডেল কার্নেগী বাংলা বই অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে বাংলাভাষী পাঠকদেরও। ডেল কার্নেগী শ্রেষ্ঠ রচনাসমগ্র এর মধ্যে আরও আছে ‘দ্য বায়োগ্রাফি অব আব্রাহাম লিংকন’, ‘ফাইভ মিনিট বায়োগ্রাফিস’ এবং ‘বিশ্বায়নের পটভূমি’। ১ নভেম্বর, ১৯৫৫ সালে আমেরিকান এই অধ্যাপক মৃত্যুবরণ করেন।