প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে ওঠার পরই একের পর এক মাথায় চাপতে শুরু করে নানান বিষয়ের দুঃশ্চিন্তা। প্রতিটি দুঃশ্চিন্তাই আলাদা রকমের। এসব চিন্তার গভীরতা ও মানসিক চাপও ভিন্ন। জীবন সংসারে চলতে গেলে এসব দুঃশ্চিন্তাকে এড়িয়ে চলা অসম্ভব। তবে কিছুটা লাঘব করা বা কিছু সময়ের জন্য হলেও দূরে ঠেলা যায়। নানান রঙের এসব চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে অনুপ্রেরণা হতে পারে গল্পগুলো। বইয়ের পাতা থেকে
জীবনের মূল্য যাচাই
একদিন একটি ছোট্ট ছেলে তার দাদুকে জিজ্ঞাসা করল, দাদু জীবনের মূল্য কত? দাদু বললেন- যাচাই করে দেখ। কিভাবে? দাদু ছেলেটির হাতে সুন্দর একটি পাথর ধরিয়ে দিলেন। বললেন, আগে বাজারে যাও। সেখানে তোমার সঙ্গে যারই দেখা হবে তার কাছে এই পাথরটির মূল্য জানতে চাইবে। দেখবে, কে কত দিতে চায়। তবে সাবধান! যে যা মূল্যই দিতে চাক না কেন - কোন মূল্যেই পাথরটি বিক্রি করবে না। এরপর আমি তোমার জবাব দেব। দাদুর কথামতো ছেলেটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। হাঁটা শুরু করে বাজারের দিকে। আধা কিলোমিটার যেতেই দেখা পায় এক কৃষক ক্ষেতে কাজ করছে। বালক তার পাথর দেখিয়ে বললো - এ পাথরটা কিনবে? কৃষক পাথরটা দেখলোই না। সোজা বলে দেয়- আরে না না। পাথর দিয়ে আমি কী করব? বালক আবার হাঁটা শুরু করে। দেখা হয় এক বেলুন বিক্রেতার সঙ্গে। নানা রঙের ফোলানো বেলুন নিয়ে চলছে। বেলুনওয়ালার কাছে যায় ছেলেটি- এই যে ভাই। এ পাথরটা বিক্রি করবো। কিনবেন? বেলুনওয়ালা পাথরটি নেড়ে চেড়ে দেখে। পছন্দ হয় তার। হ্যাঁ কিনবো? কত দাম দেবেন? পাথরটা আমাকে দাও। তোমাকে আমি দশটা বেলুন দেবো। ওহু! হবে না। ছেলেটা পাথর ফিরিয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করে। একটু যেতেই তার সঙ্গে দেখা হল একজন কমলা বিক্রেতার। পাথরটি দেখিয়ে কমলা বিক্রেতার কাছে এর মূল্য জানতে চায়। কমলা বিক্রেতা সুন্দর পাথরটি দেখে। হ্যা সুন্দরই তো পাথরটা - ভাবে সে। এই পাথরের বিনিময়ে আমি তোমাকে এক ডজন কমলা দেব। পাথরটি তুমি আমাকে দিয়ে দাও। ছেলেটি বলল, তা হবে না। এক ডজন কমলা নিয়ে পাথরটি আমি বিক্রি করব না। এরপর ছেলেটি পাথর নিয়ে যায় এক সবজি বিক্রেতার কাছে। সবজি বিক্রেতা চকচকে পাথরটা দেখে বলে, পাথরের বিনিময়ে আমি তোমাকে এক বস্তা আলু দেব। আমাকে পাথরটা দিয়ে দাও। ছেলেটির একই উত্তর, হবে না। পাথরটি আমি বিক্রি করব না। এবার পাথরটি নিয়ে গেল একজন স্বর্ণকারের দোকানে। স্বর্ণকার প্রথমে খালি চোখে পাথরটি দেখে। এরপর একটা লেন্স দিয়ে পাথরটি ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। তার মুখে হাসি। এই পাথরটির জন্য আমি দশ লাখ টাকা দেব। এর সঙ্গে তোমাকে দুটো সোনার আঙটি দেব। ছেলেটি এবারও একই উত্তর দিল, না আমি এই পাথর বিক্রি করতে পারব না। সবশেষ পাথরটি নিয়ে একজন রত্ন পাথর বিক্রেতার কাছে যায় ছেলেটি। নামী দামী পাথর বিক্রি করা হয় তার দোকানে। রত্ন বিক্রেতা পাথরটি নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে। পাথরটি মনোযোগ দিয়ে যতই দেখে ততই অবাক হয়ে যায় সে। বারবার নানাভাবে দেখার পর দোকানদার ছেলেটিকে বলে, এই পাথর কেনার সাধ্য আমার নেই। আমি সারাজীবন যা উপার্জন করেছি তাও যদি তোমাকে দিয়ে দেই, তবুও এই পাথরের মূল্য পরিশোধ হবে না। মূল্যবান এ পাথর তুমি কোথা থেকে পেলে বাছা? দোকানদারের কথা শুনে অবাক হলো ছেলেটি। পাথরের বিষয়টা সে বুঝে উঠতে পারছে না। পাথর নিয়ে সোজা ফিরে এলো তার দাদুর কাছে। দাদুকে সব ঘটনা খুলে বলল। দাদু সব শুনে তার নাতিকে বললেন, দেখো দাদু, বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে এই পাথরটি মূল্যায়ন করেছে। তুমিও এখন বুঝতে পারছো পাথরটি কতটা মূল্যবান। পাথরটির প্রকৃত মূল্য বুঝতে পেরে শেষের লোকটি বলেছেন, এই পাথর কেনার ক্ষমতা আমার নেই। দাদু বললেন, পাথরটি যেভাবে একেকজন একেকরকম মূল্যায়ন করেছে, ঠিক একইভাবে আমাদের জীবনের মূল্যটাও একেকজনের কাছে একেক রকম। যার যে রকম অভিজ্ঞতা, যার যে রকম আর্থিক সক্ষমতা, যার যে রকম জ্ঞান রয়েছে সে সেভাবেই জীবনকে মূল্যায়ন করে।
হৃদয়ের দূরত্ব
একদিন এক সাধু তার শিষ্যদের নিয়ে নদীতে গেলেন গোসল করতে। নদীর তীরে যখন পৌঁছলেন, শুনতে পেলেন পাশেই একটি বাড়িতে বেশ জোরে জোরে কথাবার্তা চলছে। পরিবারের সদস্যরা কোন কারণে রাগান্বিত হয়ে একে অপরের সঙ্গে জোরে জোরে কথা বলছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই চিৎকার চেঁচামেচিতে রূপ নেয়। সাধু শিষ্যদের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। মুচকি হেসে বললেন, তোমরা কি জানো তারা কেন একে অপরের সঙ্গে এতো উচ্চস্বরে কথা বলছে? শিষ্যরা চিন্তায় পড়ে গেলো। কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা করার পর একজন বললো, তারা তাদের শান্তি হারিয়ে ফেলেছে। এ কারণে তারা চিৎকার চেঁচামেচি করে কথা বলছে। কিন্তু কেন এতো জোরে জোরে কথা বলতে হবে, যখন আরেকজন ঠিক তোমার পাশেই উপস্থিত আছেন? তুমি যা বলতে চাও তা খুব আস্তে আস্তে বললেও তো সে তা শুনতে পায়। তাই নয় কি? জানতে চাইলেন সাধু। শিষ্যরা আরো নানা রকম ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন। কিন্তু কোন উত্তরেই সাধু সন্তুষ্ট হলেন না। সবশেষে সাধু ব্যাখ্যা করলেন উচ্চস্বরে কথা বলার কারণ। তিনি বললেন, দু’জন লোক যখন একে অপরের ওপর রাগান্বিত হয়, তখন তাদের হৃদয়ের মাঝে অনেক দূরত্ব সৃষ্টি হয়। কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকেও মনে হয় অনেক দূরে। আর এই দূরত্ব রেখে কথা বলার সময় তাদেরকে অনেক জোরে জোরে বলতে হয়। কিন্তু যখন দু’জন মানুষ একে অপরের প্রেমে পড়ে যায় তখন কি হয়? -জিজ্ঞাসা করলেন সাধু। তিনিই নিজেই উত্তর দিলেন। বললেন, যখন দু’জন মানুষ একে অপরকে ভালোবাসে তখন তাদের হৃদয় অনেক কাছে চলে আসে। দূরের মানুষকেও মনে হয় কত কাছে আছে। তাদেরকে আর জোরে জোরে কথা বলতে হয় না। আস্তে আস্তে কথা বললেই তারা শুনতে পায়। সাধু আরো বললেন, যখন তারা পরস্পরকে আরো বেশি ভালোবাসে তখন কি ঘটে? তখন তারা শুধু ফিসফিস করে কথা বলে। তারা পরস্পরকে আরো বেশি ভালোবাসতে শুরু করে, আরো অনেক কাছে চলে আসে। সবশেষ তাদেরকে আর কথা বলার প্রয়োজন হয় না। তখন তারা শুধু একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে, এটাই তাদের জন্য যথেষ্ট। সাধু তার শিষ্যদের দিকে আবারো তাকালেন এবং বললেন, সুতরাং যখন তোমরা তর্কে জড়াবে তখন তোমাদের হৃদয়ের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হতে দিও না। এমন কোন কথা বলো না, যা তোমাদের পরস্পরের মধ্যে আরো দূরত্ব সৃষ্টি করবে। না হলে এমন একদিন আসবে যখন তোমাদের মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব সৃষ্টি হবে এবং সেখান থেকে আর ফিরে আসার কোন পথ খুঁজে পাবে না।
সাহিত্য, সঙ্গীত ও শিল্পকলার প্রতি আজন্ম অনুরক্ত মোঃ আবদুর রহমান আবির, লেখাপড়া বিপরীত প্রবাহে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিষয়ে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর শেষে আইন বিষয়ে স্নাতক। পেশাজীবন শুরু জাতীয় দৈনিকে সাংবাদিকতা দিয়ে। তারপর টেবিল বদল হলেও পেশা বদল হয়নি। কাজের পাশাপাশি লেখালেখি। আঁচড় কাটাকাটিও চলে আপন মনের তাগিদে। বিখ্যাত অখ্যাত স্থান ভ্রমন আর তা নিয়ে নিজের মতো করে লিখে রাখা। আর ঈশপের গল্পের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রেরণার গল্প খুঁজে দেখা। কিন্তু কতটুকুই আর হলো। জন্ম ১১ জুন ১৯৮৯ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জের সলঙ্গা থানার বাসুদেবকোল গ্রামে মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারে। পিতা মোঃ ইসমাইল হোসেন, মাতা আম্বিয়া খাতুন। সবকিছু বদলে দেয়ার সক্ষমতা না থাকলেও চেষ্টা করে দেখতে পিছপা হওয়ার নয়। সে প্রচেষ্টার তাড়নায়ই সাংবাদিকতায় আসা। তারপর আর থেমে যাওয়া মাথায় আসেনি।