"ভ্রামণিক রবীন্দ্রনাথ" ফ্ল্যাপে লেখা কথা: বাঙালি জাতি হিসেবে সাধারণত ভ্রমণবিমুখ। মূলত বৈরাগ্য বিলাসেই তার মুক্তি। গৃহ তার কাছে বিশ্ব, বিশ্ব তার কাছে গৃহকোণ। নতুনে তার বিরাগ, পুরাতনে অনুরাগ। গতিতে সে নিস্পৃহ, স্থিতিতে সে স্পৃহ। বাঙালির এই স্বভাব প্রবণতা থেকে আরও অনেক কিছুর মতাে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালিকে প্রবুদ্ধ করেছিলেন ভ্রমণের মুক্তধারায়। রবীন্দ্রনাথই বাঙালির সবচেয়ে বড় ভ্রামণিকের উদাহরণ। তিনি আজও আমাদের ভ্রমণ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা। তাঁর মতাে ভ্রমণ বিষয়ক এত গ্রন্থ আর কোনাে বাঙালি আজও লেখেননি। তিনি জীবনে কত হাজার মাইল ভ্রমণ করেছেন সেটি গবেষণার বিষয়, কিন্তু লিখেছেন হাজার পৃষ্ঠার মতাে। এর মধ্যেই বিধৃত রয়েছে প্রায় গােটা বিশ্বের ইতিহাস, ভূগােল, মানবসমাজের। শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতিঐতিহ্যসহ মানব চৈতন্যের দীপ্তি। তাঁর দেখা ও উপলব্ধির উজ্জ্বল ভুবনও অনেকাংশে আয়ত্তীকৃত এই ভ্রমণ কথার চরণে চরণে। কবির সেই বিশ্ব-লােককে পাঠক সমাজের সামনে তুলে ধরা এবং পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যই এই গ্রন্থের অবতারণা। শুধু তা-ই না, তাঁর ভ্রমণ সাহিত্য রচনার নবরীতি, ভ্রমণ কলা ও তুলনামূলক আলােচনার প্রয়াসও রয়েছে এই গ্রন্থে। তিনি যে পৃথিবীর এক অন্যতম ভ্রমণ সাহিত্যিক, গ্রন্থটি তারও এক অভিজ্ঞানে ঋদ্ধ। সব মিলে রবীন্দ্রনাথের অতি মূল্যবান অথচ সবচেয়ে অমূল্যায়িত ও অনালােচিত তার ভ্রমণ সাহিত্য। সেই প্রেক্ষিতটি বিবেচনায় রেখে তার ভ্রমণ সাহিত্যকে পাদপ্রদীপের আলােয় এনে দীপ্ত করা ও উদ্ভাসিত করার উদ্যতিতে এই গ্রন্থের উন্মীলন। বলা যায়, রবীন্দ্রবিশ্বে অনুপ্রবেশের এক অন্যতম সিংহদ্বার তাঁর ভ্রমণ সাহিত্য।
গাজী আজিজুর রহমান-এর জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর ভারতের দার্জিলিংয়ে। তাঁর পিতা কাসেম আলী গাজী, মা করিমন্নেসা। তিনি ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ কলেজে বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যােগ দেন। ১৯৭৫ সালে এবং অধ্যাপক পদ থেকে অবসরগ্রহণ করেন ২০১০ সালে। গাজী আজিজুর রহমানের লেখার একটি ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিশেষ করে মৃত্যু, আত্মহত্যা এবং কবিতাবিষয়ক লেখাগুলাে পাঠককে বার বার ভাবিত করে, প্রশ্নমুখী করে তােলে। বিশ্বসাহিত্য, ইতিহাস, আধুনিকতা তাঁর প্রিয় লেখালেখির বিষয়। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ, প্রবন্ধ গবেষণা : ভ্রামণিক রবীন্দ্রনাথ (২০১৯), কবিদের কবি : জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, আবুল হাসান (২০১০ ও ২০১৮), বাংলার দ্বিতীয় রেনেসাঁ (২০১৮), স্বদেশ ভাবনা ও বঙ্গবন্ধু (২০১৭), সাহিত্যে সমাজবাস্তবতার ধারা (১৯৯২ ও ২০১৪), স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে কবি (১৯৯৬ ও ২০১৫), কালীগঞ্জের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ (২০১৪), সাহিত্য ও সিংহাসন (১৯৯৯), আধুনিক বাংলা উপন্যাসের বিষয় ও শিল্পরূপ (২০০৯), সাতক্ষীরার ভাষা ও শব্দকোষ (২০০৪), নােবেল সাহিত্য পুরস্কারের শতবর্ষ (২০০১); সম্পাদনা : মরণরে তুহু মম (২০০৪) এবং খান আনসার উদ্দীন আহমেদ রচনাবলী (১৯৯৯); উপন্যাস : বক্সের বাঁশি (১৯৮৯), যােদ্ধার জতুগৃহ (১৯৯১), শামুক (১৯৯৬); নাটক : সক্রেটিস (১৯৯৩), চন্দ্রাবতী (১৯৯৬), কালাে সূর্যের নিচে (১৯৯১), অভাজন (১৯৯৯)।। সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বেশ কয়েকটি পুরস্কার। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে- সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৫), শিমুল-পলাশ সাহিত্য পুরস্কার, (কলকাতা ২০০৪), বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র পুরস্কার (২০০৭), সিকানদার আবু জাফর পদক (২০১২), কবি সুকান্ত পুরস্কার (কলকাতা ২০১৫)। দীর্ঘদিন সম্পাদনা করে যাচ্ছেন নদী নামের একটি সাহিত্যপত্র।