"গল্পের চেয়েও রোমাঞ্চকর (বাইশ বছরের গোপন জীবন)" ফ্ল্যাপে লেখা কথা: ঘটনা ঘটে যায় যখনই তখনই আমরা জানতে পারি না। ঘটনার পেছনের কত ঘটনা, কত বেদনা, কত চোখের জল, কত দুঃখ-বেদনা লুকিয়ে থাকে তখনই তা আমরা জানতে পারি না। কিন্তু এক লহমায় বাংলাদেশ যখন স্পষ্ট হয়ে এল, তারও পেছনে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, পঁচিশে মার্চের প্রতিরােধ-সব মানুষ যেন একটা শারীর হয়ে গেল। শরণার্থী, অবর্ণনীয় কষ্টের জীবন। এপারে-ওপারে, তারও আগে ১ মার্চ সংসদ অধিবেশন স্থগিতের ঘােষণায় ক্ষ্যাপাটে ৩ মার্চের সেদিনের ঘটনায়, তারও আগে ৭০এ পাকিস্তানের সংবিধান সভায় ইয়াহিয়ার অধিনে নির্বাচন, নির্বাচন বর্জন, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। তারও আগে জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, রাজনৈতিক অধিকার বন্ধ। কী করা? বলি সে ৭০ এর প্রথম দিনে প্রথম মুহুর্তে রাত ১২টা ১ মিনিটে, মধ্যাহ্নে রাজনীতি খান খান হয়ে গেল। দেবেন দেবেন সিকদারের মুক্তি চাই-কী কেন কীসের আওয়াজ কীসের শব্দ? পাখি উড়ে যায়, কাকেরা কা কা করে, বকেরা ডানা ঝাপটায়, স্লোগান, মানুষের ঘুম ভাঙা-সব একাকার হয়ে যায়। দশ দিগন্ত ভেসে যায়, ভাের হওয়ার আগেই ভাের হয়ে যায়। টক অব দ্যা টাউন কথাটা তখনও চালু না, চাউর হয়েছিল। কেউ বলে সেভেন সেভেন সিকদার কে, কেউ বলে দেবেন। সিকদার কে-পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা দেবেন-বাশারের দেবেন সিকদার। আণ্ডারগ্রাউণ্ডে ছিলেন, তিনি গ্রেফতার হয়েছেন আগেই। কোনও কিছুই হতে দেয়া যাবে না, কোথাও থাকা যাবে না, কমীরা তাঁকে রাজশাহী জেল ভেঙে চাপাইনবাবগঞ্জ, মালদহ হয়ে মুর্শিদাবাদ হয়ে কোলকাতায় তিনি উপস্থিত। এরও আগে তার মুক্তির দাবির স্লোগানে স্লোগানে, ৬৯ এর শাহপুর কৃষক সম্মেলনে খুলনা হয়ে চট্টগ্রাম থেকে মিটিং হয়ে চাপাইনবাবগঞ্জের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্রের লাল টুপির সমাবেশে, পাঁচবিবিতে, সন্তোষের লাল টুপির সম্মেলনে, ৭০ এ এসএম হলের বাগানে। পূর্ব বাংলার ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে দেবেন সিকদারের উপস্থিতিতে, ৭০ এ লাল দীঘির ময়দানে দেবেন-বাশারের নাম ওঠে বারেবারে। এরপর তাকে দেখা গেল কুষ্টিয়ার কামালপুরের এক প্রফেসরের বাসায়। এপ্রিল মাস। প্রতিপক্ষের সাথে রাজনৈতিক বনিবনা হল না। তিনি অন্যদের ওপারে যেতে বললেন, এরা ওপারে যাবে না। ভাগ হয়ে গেলে রাজনীতি। তিনি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটিতে থাকলেন। ওপারে গেলেন। এটা তার জানা জীবন, অন্যরাও তা জানেন। কিন্তু এর বাইরে আছে কঠিন, কঠোর জীবন। তার রােমাঞ্চকর আণ্ডারগ্রাউণ্ডও না, কী নাম দেবেন-ডাকবেন। পাঠককে নিজেই তা বেছে নিতে হবে। তিনি কাকেদের বিচার দেখেছেন, দুশ্চরিত্র কাকেদের শাস্তি দিতে দেখেছেন, কাকেদের মধ্যে মনুষ্যত্ব দেখেছেন কিন্তু আজকে আমরা, মানুষেরা কত কত ধর্ষণের বিরুদ্ধে কাকস্য প্রতিবাদ কি দেখেছি? ধর্মবিরােধী দেখেছেন, আন্দোলন ও বিজয় দেখেছেন, শিক্ষা নিয়েছেন। আজ আমরা মানুষেরা শ্রমিক ইউনিয়নের নামে এনজিও মালিকদের দালালি আর কিছু কিছু চাঁদাবাজি আর ব্যক্তিস্বার্থে জড়িয়ে গেলাম। যে কৃষক লাল টুপির সম্মেলনে গিয়ে তার নাম শুনেছেঃ লাঠি হাতে পালাে কাঁধে/চল সারি সারি/ সকলের আগে-এরকম আন্দোলন করেছেন কৃষক বিদ্রোহের নেতারা, নেতারা গ্রাম্য কবিতা হয়ে উঠেছেন.... এইসব সফলতা-ব্যর্থতা ধারণ করে দেবেন সিকদার তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন দেবেন সিকদার। আণ্ডারগ্রাউণ্ড জীবনে চলে গিয়েছিলেন, না তাকে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল? যারা বাধ্য করেছিল তারা নাই ইতিহাসে। নাই মানে? আছে, ইতিহাসের খলনায়ক হয়ে। ক্ষমতাসীন বাংলাদেশে বিপ্লব বিদ্রোহ সবই হয়েছে, হচ্ছে। তীব্রতা বেড়েছে। আজ আর আণ্ডারগ্রাউণ্ডে যাওয়া যাচ্ছে না। নিখোঁজ হতে হচ্ছে, গুম হতে হচ্ছে, মূক বধির হতে হচ্ছে। গণতন্ত্র এখানে গােল্লায় গেছে! গণতন্ত্রে গ এখানে গােল্লায় গেছে ন তে নষ্ট হয়ে গেছে, ত তে তাবৎ কামাক্ষা মন্ত্র হয়েছে। তাও প্রকাশ্যে বলা যাচ্ছেনা। আণ্ডারগ্রাউণ্ডেও যাওয়া যাচ্ছে না, শুয়ে থাকা যাবে না, দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না, টু করা যাবে না এরকম একটি অবস্থা। তার বইটি আমরা দেখব ব্যক্তি হিসেবে না। ব্যক্তির ভুল-ত্রুটি আছে, থাকবে। কিন্তু জনগণই তাদের ইতিহাসের স্রষ্টা। অথবা এখানেই জনসাধারণ এখানেই রাজনীতির আরম্ভ। সাত তােরণের থীবস নগরী গড়েছে কারা? ইতিহাসে শুধু রাজাদেরই নাম পাবে/ রাজারা কখনও পাথর বয়েছে কাধে?