“বর্তমান বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের উপর কাফির-মুশরিক জোটের সম্মিলিত আগ্রাসন, পবিত্র ভূমি জেরুজালেম বে-দখল আর শামের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে আমরা ইতিহাসের মহাবীর সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর (রহি:) সময়ের সাথে কিছুটা মেলাতে পারি। দুনিয়া আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে অন্ধ মুসলিম শাসকবর্গ যখন উম্মাহকে ভুলে গিয়েছিলো, একজন সালাহউদ্দীন সেদিন একাই একটি উম্মাহ হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। মিসর হয়ে শামে শান্তি ফিরিয়ে এনেছেন, জেরুজালেমকে কাফিরদের হাত থেকে পবিত্র করেছেন, আর সমস্ত বিশ্ববাসীর কাছে সাহসিকতা, বিচক্ষণতা আর মহানুভবতার যে নজির রেখে গেছেন সেটা মুসলিম বিশ্ব তো বটেই; অমুসলিম ইতিহাসবিদরাও গুরুত্বের সাথে স্মরণ রেখেছেন। এই বইটি থেকে যদি পাঠকরা উপকৃত হয়, আমাদের মায়েরা যদি তাঁদের সন্তানদেরকে একেকজন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন বুনে, যদি সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মাঝে সালাহউদ্দীনের মত দ্বীনের সম্মানে ঝাঁপিয়ে পড়ার সেই পৌরুষ ফিরে আসে, তবেই আমরা স্বার্থক ইন শা আল্লাহ” -সম্পাদক উসমানি খিলাফতের প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত প্রায়। তখনই সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা শকুনগোষ্ঠীর লোভাতুর চোখ গিয়ে পড়ে খেলাফতের অধীনস্থ আফ্রিকার মুসলিম ভূখণ্ডগুলোর ওপর। তারা এসব ভূখণ্ডকে রাজাবিহীন রাজ্য হিসেবে ধরে নেয়। ইতালি ঝাঁপিয়ে পড়ে লিবিয়ায়। ১৯১১ সালে লিবিয়ার সমুদ্র উপকূলে নোঙর করে ইতালিয়ান রণতরীগুলো। পিঁপড়ের মতো বেরিয়ে আসে হাজার হাজার ইতালিয়ান সৈন্য। সিংহ যেমন আস্তানা ছেড়ে গর্জন করতে করতে বনের খোলা মাঠে বেরিয়ে আসে, তেমনি জাবালে আখজারের আল-কুসুর খানকাহ থেকে রণহুংকারে সদলবলে ময়দানে বেরিয়ে আসেন উমর মুখতার। বয়সের ভারে ন্যুব্জ সানুসি সুফি আন্দোলনের আধ্যাত্মিক জগতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব তিনি। রাতের সাধক আর দিনের অশ্বারূঢ়। দাড়ি, টুপি আর আলখাল্লা পরিহিত দরবেশ। কুরআন-হাদিসের মশালধারী একজন জবরদস্ত আলেম। ঔদ্ধত সিংহের ন্যায় মৃত্যুর প্রতি একেবারে উদাসীন কতজন সাথিকে সঙ্গে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন দখলদার ইতালিয়ানদের বিরুদ্ধে। ১৯১১ থেকে নিয়ে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত এই ২০টি বছর প্রায় ২৬৩ রণক্ষেত্রে অত্যন্ত বীরদর্পে লড়াই করে যান। প্রতিটি যুদ্ধে চোখে শর্ষেফুল দেখতে থাকে ইতালিয়ান বাহিনী।ইতালি সরকার তার সাথে বারবার সমঝোতা করতে চেয়েছে; কিন্তু প্রতিবারই তিনি এককথা বলেছেন; যা ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করে রেখেছে—‘আমরা আত্মসমর্পণ করি না; আমরা হয় জিতি, না হয় মরি।’ সেই মরুসিংহ উমর মুখতারের জীবন ও কীর্তি নিয়ে রচিত এই বইটি।
ফকিহ, রাজনীতিক ও বিশ্বখ্যাত ইতিহাসগবেষক। ইসলামের ইতিহাসের উপর বিশ্লেষণধর্মী তাত্ত্বিক গ্রন্থ রচনা করে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। এই মহা মনীষী ১৯৬৩ সনে লিবিয়ার বেনগাজি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা বেনগাজিতেই করেন। যৌবনের প্রারম্ভেই গাদ্দাফির প্রহসনের শিকার হয়ে শায়খ সাল্লাবি আট বছর বন্দি থাকেন। মুক্তি পাওয়ার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি সাউদি আরব চলে যান। মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়া ও উসুলুদ্দিন বিভাগ থেকে ১৯৯৩ সনে অনার্স সম্পন্ন করেন। তারপর চলে যান সুদানের উম্মু দুরমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে উসুলুদ্দিন অনুষদের তাফসির ও উলুমুল কুরআন বিভাগ থেকে ১৯৯৬ সনে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৯৯ সনে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘ফিকহুত তামকিন ফিল কুরআনিল কারিম’। ড. আলি সাল্লাবির রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু বিশ্বখ্যাত ফকিহ ও রাজনীতিক ড. ইউসুফ আল কারজাবি। কারজাবির সান্নিধ্য অর্জনে তিনি ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে কাতার গমন করেন। নতুন ধারায় সিরাত ও ইসলামি ইতিহাসের তাত্ত্বিক গ্রন্থ রচনা করে ড. আলি সাল্লাবি অনুসন্ধিৎসু পাঠকের আস্থা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। নবিজির পুর্ণাঙ্গ সিরাত, খুলাফায়ে রাশিদিনের জীবনী, উমাইয়া খিলাফত, আব্বাসি খিলাফত, উসমানি খিলাফতের উত্থান-পতনসহ ইসলামি ইতিহাসের সাড়ে তেরোশ বছরের ইতিহাস তিনি রচনা করেছেন। তা ছাড়া ইসলামি ইতিহাসে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করা ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি আলাদা আলাদা গ্রন্থ রচনা করেছেন। ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবির রচনা শুধু ইতিহাসের গতানুগতিক ধারাবর্ণনা নয়; তাঁর রচনায় রয়েছে বিশুদ্ধতার প্রামাণিক গ্রহণযোগ্যতা, জটিল-কঠিন বিষয়ের সাবলীল উপস্থাপনা ও ইতিহাসের আঁকবাঁকের সঙ্গে সমকালীন অবস্থার তুলনীয় শিক্ষা। এই মহা মনীষী সিরাত, ইতিহাস, ফিকহ ও উলুমুল কুরআনের উপর আশির অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচনাবলি ইংরেজি, তুর্কি, ফরাসি, উর্দু ও বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে পৃথিবীর জ্ঞানগবেষকদের হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। আল্লাহ তাঁকে দীর্ঘ, নিরাপদ ও সুস্থ জীবন দান করুন। আমিন। —সালমান মোহাম্মদ লেখক, অনুবাদক ও সম্পাদক ২৪ মার্চ ২০২০