"কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র - অখণ্ড সংস্করণ" বইটি সম্পর্কে কিছু কথা: প্রাচীন ভারতের ঐতিহাসিক বিভিন্ন যুগে দেশের বিভিন্ন প্রদেশের সমসময়ে বা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আমরা রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতি বা বর্গতন্ত্র ও কুলস্বামিক রাজ্যের শাসনপ্রণালী প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত ছিল বলিয়া জানিতে পারি। কিন্তু, অধিকসংখ্যক রাজ্যেই রাজতন্ত্রশাসনের ব্যবস্থাই নিয়মিত ছিল। রাজ্যের বা রাজশক্তির তত্ত্ববিশেষণে রত প্রাচীন রাজনীতিবিদগণ মানব প্রকৃতির দোষভাগের কথা কখনই বিস্মৃত হইতেন , কারণ, তাঁহারা ভাবিতেন যে, শীল ও সদাচারের ভ্রংশকারী ও অন্যের স্বাধীনতা ও অধিকারে হস্তক্ষেপকারী অসজ্জনের অভাব কখনই সমাজে ছিল না। কাজেই দুষ্টজনের অত্যাচার ও পাপাচারণ নিবারিত রাখিবার জন্য শাসনতন্ত্রের প্রয়ােজনীয়তা সৰ্ব্বদাই উপলব্ধ হইত। অন্যথা, জনগণের জীবন ও সম্পত্তির রক্ষণকার্যে ও তাহাদের শাস্ত্রবিহিত বর্ণাশ্রমধৰ্ম্মের পালনকাৰ্য্য অচল হইয়া যাইতে পারে—এই ভয় অস্বাভাবিক নহে। প্রাচীন হিন্দু-রাজনীতিতে লােকের জীবন ও সম্পত্তি এবং ধর্মরক্ষারূপ দুইটি প্রধান মূল বিষয়ের চিন্তা, আললাচনা ও নির্ণয় পরিদৃষ্ট হয়। কিন্তু, এই দুইটি বিষয়ই নির্ভর করে রাজার দণ্ডশক্তি-প্রণয়নদ্বারা লােকসমাজের কণ্টক বা দোষকারীকে শাস্তি দেওয়ার উপর। প্রজাসমূহের হিত ও সুখবিধানই রাজার প্রধান ও প্রথম কর্তব্য এবং তাঁহার দ্বিতীয় কর্তব্য হইল লােকস্থিতি বা সমাজ শৃঙ্খলা ব্যবস্থিত রাখা। সেই জন্য রাজাকে ‘দণ্ডধর’ বলিয়াও অভিহিত করা হয়। বরং তাঁহাকে দণ্ডশক্তির বিগ্রহ বলিয়াও পরিচিত করা যায়। রাজনীতিশাস্ত্রে তাহাকে চতুৰ্ব্বর্ণের ও চতুরাশ্রমের প্রতিভু’ বলিয়াও বর্ণিত দেখা যায়। কৌটিল্য, কামক, শুক্র প্রভৃতির রচিত রাজনীতি বা দণ্ডনীতিশাস্ত্রে, মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, নারদ প্রভৃতির রচিত স্মৃতিশ্রন্থে, রামায়ণ ও মহাভারতের এবং পরবর্তী | সময়ের মহাকবিগণের রচিত মহাকাব্যাদিতেও রাজদণ্ড বিষয়ে যথেষ্ট আলােচনা পরিদৃষ্ট হয়। রাজ্যকে মাৎস্যন্যায়ের অভিভব হইতে রক্ষা করিতে হইলে, রাজাকে দুষ্টশাসনের শক্তি প্রয়ােগ করিতেই হইবে। তাহা না হইলে, জলমধ্যে বৃহদাকার মৎস্যসমূহের গ্রাস হইতে যেমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৎস্যসমূহ আত্মরক্ষা করিতে পারে না, তেমন রাজ্যেও রাজ্যশাসনের বিধান যথাযথভাবে প্রচলিত না থাকিলে, সমাজে সবলের কবল হইতে দুৰ্বলকে রক্ষা করা কঠিন হইয়া পড়ে। অতএব, ইহা নিশ্চিত যে, রাজার প্রভুশক্তি (কোশদণ্ডজ তেজঃ) ও নিগ্রহশক্তির ভয়েই দুষ্কৃতকারীরা ভীত ও ত্রস্ত থাকে, এবং লােকসমাজের শৃঙ্খলা ও যােগক্ষেম রক্ষিত হয়। খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে কৌটিল্য নিজেই এই অর্থশাস্ত্র রচনা করিয়াছিলেন এরূপ যাঁহাদের মত, সেই মতই সমীচীন; এবং ইহা পরবর্তী কোন যুগে রচিত হইয়া থাকিবে এইরূপ মত ততটা সমাদরণীয় হইতে পারে না। মৌৰ্যসাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পূৰ্ব্বে, অথবা (ইহাই অধিকতর সম্ভাবনার কথা), মগধের সিংহাসনে মৌৰ্যরাজ চন্দ্রগুপ্তকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া তদীয় রাজ্যটিকে লব্ধপ্রশমন-রীতিতে দৃঢ়সংহত করার পরে, কৌটিল্য, মহামন্ত্রীর কঠিন ও শ্রমবহুল কর্তব্য হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া এই অর্থশাস্ত্রখানি প্রণয়ন করিয়া থাকিবেন। এই মতের পরিপােষণার্থ আমরা অর্থশাস্ত্রের যে চারটি শ্লোকে (১১, ২১০, ১৫১ ও গ্রন্থাবসানের শ্লোকে) কৌটিল্যকে (ওরফে বিষ্ণুগুপ্তকে) অর্থশাস্ত্ৰকৃৎ বলিয়া উল্লিখিত পাই, সে-কথা ভুলিয়া যাইতে পারি না অতএব, এইরূপ বিশ্বাস অযুক্তিযুক্ত হইবে না যে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের সচিবায়ত্ত সাম্রাজ্যে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতির যে প্রচলিত অবস্থা মহামন্ত্রিহিসাবে কৌটিল্য লক্ষ্য করিয়াছিলেন তাহা, এবং চাতুরন্ত মহীপতিত্বের আকাক্ষী যে-কোন বিজিগীষুর পক্ষে যেরূপ আদর্শ শাসনপ্রণালী ও ব্যবহারপদ্ধতির প্রচলন করা আবশ্যক তাহা—এই উভয়বিধ অবস্থা উদ্দেশ্য করিয়াই তিনি নিজরচিত অর্থশাস্ত্রের আলােচ্য ও প্রতিপাদ্য বিবিধ বিষয়ের অবতারণা ও মীমাংসা লিপিবদ্ধ করিয়া থাকিবেন। শ্রীরাধাগােবিন্দ বসাক