আল্লাহর ভয়ে নবী-রাসুলদের কান্না! হাসি-কান্না মানুষের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য। আনন্দ ও বেদনা, সন্তুষ্টি ও অসন্তোষ, আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশের সময় মানুষ হাসি বা কান্নার আশ্রয় নেয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই তিনি হাসান এবং তিনি কাঁদান।’ (সুরা : নাজম, আয়াত : ৪৩) আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, ‘পৃথিবীতে আল্লাহ মানুষের জীবনে হাসি ও কান্নার কারণ সৃষ্টি করেন এবং পরকালে মানুষের কৃতকর্মের ফল হিসেবে তারা হাসি ও কান্নার জীবন যাপন করবে।’ (তাফসিরে তাবারি) হাসি ও কান্না যখন ইবাদত। হাসি ও কান্না মানুষের সত্তাগত ও প্রকৃতিগত বিষয় হলেও ‘কারণ ও উপলক্ষ’ বিবেচনায় তা ইবাদত হিসেবেও গণ্য হতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জাহান্নামের আগুন দুটি চোখকে স্পর্শ করবে না। আল্লাহর ভয়ে যে চোখ কান্না করে এবং আল্লাহর রাস্তায় যে চোখ পাহারা দিয়ে ঘুমবিহীনভাবে রাত পার করে দেয়।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস ১৬৩৯) মহানবী (সা.) অন্য হাদিসে বলেন, ‘তোমার ভাইয়ের সামনে মুচকি হাসা সদকাস্বরূপ।’ (তিরমিজি, হাদিস ১৯৫৬) মুমিনের কাছে কান্নাই প্রিয়। মুমিনের চোখের পানি আল্লাহর কাছে প্রিয়, তাই মুমিনের কাছে কান্না প্রিয় আমল। পৃথিবীতে বেশি হাসাহাসি ও ক্রীড়া-কৌতুক করা মুনাফিক বা কপট লোকের বৈশিষ্ট্য। পার্থিব জীবনে আল্লাহর ভয়ে মুমিনের হৃদয় থাকে কোমল। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতএব তারা (পার্থিব জীবনে) কিঞ্চিৎ হেসে নিক এবং (পরকালে) তারা প্রচুর কাঁদবে, তাঁদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৮২) আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এই আয়াত মুনাফিকদের নিন্দায় অবতীর্ণ হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘পৃথিবী ক্ষণস্থায়ী। সুতরাং এখানে তারা যত খুশি হেসে নিক। অতঃপর যখন তারা আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে, তাদের অন্তহীন কান্না শুরু হবে।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির) মুনাফিকের এই হাসি-কৌতুকের বিপরীতে রাসুলুল্লাহ (সা.) মুমিনকে কান্নার বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা কান্নাকাটি করো, যদি কাঁদতে না পারো তবে কান্নার ভান করো বা কাঁদার চেষ্টা করো।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস ৪১৯৬ যে কান্না আল্লাহর কাছে অমূল্য। মহানবী (সা.) মুমিনকে কাঁদতে বলেছেন, তবে তা পার্থিব আবেগ-অনুভূতির জন্য নয়; বরং মুমিন কাঁদবে আল্লাহর ভয়ে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সাত শ্রেণির মানুষকে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাঁর আরশের নিচে ছায়া দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। তাদের এক শ্রেণি, যারা নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার চোখ দুটি অশ্রুসিক্ত হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস ৬৮০৬) অন্য হাদিসে এসেছে, ‘দুটি ফোঁটা ও দুটি চিহ্নের চেয়ে বেশি প্রিয় আল্লাহ তাআলার কাছে আর কিছু নেই। আল্লাহর ভয়ে যে অশ্রুর ফোঁটা পড়ে, আল্লাহর পথে যে রক্তের ফোঁটা নির্গত হয় এবং আল্লাহর নির্ধারিত কোনো ফরজ আদায় করতে গিয়ে যে চিহ্ন সৃষ্টি হয়।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস ১৬৬৯) নবী-রাসুলদের কান্না। পৃথিবীর সব নবী ও রাসুল নিষ্পাপ ছিলেন। তবু তাঁরা আল্লাহর ভয়ে ভীত ছিলেন, আল্লাহর ভয়ে তাঁরা কান্না করতেন। আল্লাহর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রভাবে তাঁরা কান্না করতেন। তা ছাড়া উম্মতকে শিক্ষাদানও তাঁদের কান্নার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এরাই তারা, নবীদের মধ্যে যাদের আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন আদমের বংশ থেকে এবং যাদের আমি নুহের সঙ্গে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম; ইবরাহিম ও ইসমাইলের বংশোদ্ভূত এবং যাদের আমি পথনির্দেশ করেছিলাম ও মনোনীত করেছিলাম, তাদের কাছে দয়াময়ের আয়াত তিলাওয়াত করা হলে তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ত কাঁদতে কাঁদতে।’ (সুরা : মারইয়াম, আয়াত : ৫৮) আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এলাম, তখন তিনি নামাজ আদায় করছিলেন আর তাঁর ভেতরে ডেকচির শব্দের মতো শব্দ হচ্ছিল, অর্থাৎ তিনি কাঁদছিলেন।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস ১২১৪) আয়েশা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রচণ্ড রকম কাঁদতে দেখে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কাঁদছেন! অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বের ও পরের সব গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হব না?’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ২/৩৮৬) আল্লাহর ভয়ে না কাঁদা নিন্দনীয়। আল্লামা ইবনু কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘যখন চোখ আল্লাহর ভয়ে বিগলিত হয় না, তখন জেনে রেখো, হৃদয়ের কঠোরতার কারণে তা শুকিয়ে গেছে। আর কঠোর হৃদয় আল্লাহর থেকে সবচেয়ে দূরে।’ (বাদায়িউল ফাওয়াইদ : ৩/৭৪৩) আর রাসুলুল্লাহ (সা.) হৃদয়ের কঠোরতা থেকে মুক্তি চেয়ে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই এমন জ্ঞান থেকে, যা কোনো উপকারে আসে না; এমন হৃদয় থেকে, যা ভীত হয় না; এমন আত্মা থেকে, যা তৃপ্ত হয় না এবং এমন আহ্বান থেকে, যাতে সাড়া দেওয়া হয় না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস ২৭২২)