"পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের বন্দিজীবন"বইটির সম্পর্কে অনুবাদকের কিছু কথা: আহমেদ সালিম সেইসব বিরল পাকিস্তানিদের একজন, উন্মত্ততায় অন্ধ সমাজবেষ্টনীতেও যাঁরা বিবেকের নির্দেশ বিস্মৃত হন নি এবং প্রবল বিরুদ্ধতার মধ্যেও সত্যপ্রকাশে কুণ্ঠিত ছিলেন না। তাই বাংলাদেশে গণহত্যার খবর জেনে তিনি লাহােরে ক্ষীণভাবে হলেও তাৎপর্যময় প্রতিবাদ সংগঠনে ব্রতী হয়েছিলেন। পাকসামরিক বাহিনীর নৃশংস হত্যা-অভিযান তাঁর কবিচিত্তেও আলােড়ন তুলেছিল এবং একাধিক কবিতায় তিনি সেই পরিচয় রেখেছেন। বর্তমান গ্রন্থের সূচনায় এমনি এক কবিতার কথা উল্লিখিত হয়েছে এবং গ্রন্থের শেষে তিনি উচ্চারণ করেছেন ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতার পঙক্তি। এর বাইরে অবশ্য ব্যক্তিগত কোনাে অনুভূতির প্রকাশ গ্রন্থে নেই, তিনি বরং গবেষকের দৃষ্টি নিয়ে পাকিস্তানি কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের দুঃসহ দিনগুলাের বিবরণী দাখিল করতে সচেষ্ট হয়েছেন। পাকিস্তানে এই কাজটি করতে যাওয়া এখনাে খুব সহজ নয়। অনেকরকম সমালােচনা ও বাধার তিনি সম্মুখীন হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট অনেক ব্যক্তিই এখনাে মুখ খুলতে রাজি হন নি। তারপরও বিভিন্ন সূত্রের তথ্য ও মুদ্রিত বিবরণী একত্র করে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের এক অজানা ও অনালােচিত পর্বে আলােকসম্পাতে তিনি সচেষ্ট হয়েছেন। তবে আহমেদ সালিম যতােটা না বলেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি ইঙ্গিত রেখেছেন। বিভিন্ন মতের উল্লেখকালে অনেক সময় তার সত্যাসত্য বিচারের ভার পাঠকের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন এবং এইভাবে গবেষকের নিস্পৃহতার আবরণে সত্যকে মেলে ধরতে চেয়েছেন। পাঠককে খুঁজে নেয়ার জন্য। এক্ষেত্রে তাঁর কাম্য হয়েছে সজাগ ও সক্রিয় পাঠক। | আহমেদ সালিমের বিবরণী থেকে আরেকটি বিষয় মনে না জেগে পারে না। তা'হলাে পাকিস্তানি কারাগারে দিনের পর দিন মাসের পর মাস ক্ষুদ্র নির্জন প্রকোষ্ঠে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গভাবে বন্দিজীবন কাটানাের দুঃসহতা বঙ্গবন্ধু কীভাবে বরণ করেছিলেন? নির্জন কারাবাসের তীব্র যন্ত্রণা লিখে প্রকাশ করা কঠিন, আর যেই মানুষ ফাসিতে মৃত্যুর মুখােমুখি হয়ে দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে সম্পূর্ণ বৈরী পরিবেশে এমনি নিঃসঙ্গ কারাবাসে রয়েছেন তাঁর যন্ত্রণার তীব্রতা অনুভব করাও দুঃসাধ্য। এটা লক্ষণীয় মুক্তির পর নির্জন কারাবাসের যন্ত্রণার প্রসঙ্গ বঙ্গবন্ধু বিশেষ উল্লেখ করেন নি। তবে তাঁর মানুষী-সত্তা ভেঙে দেয়ার জন্য যে এই প্রয়াস সে-কথা উল্লেখ করে এটা অতিক্রমের শক্তি তথা বাংলার মানুষের ভালােবাসার জোরের কথা তিনি বারবার বলেছেন। যে-কোনাে মানুষকে ভেঙে ফেলতে নির্জন কারাবাসের যন্ত্রণা যে অতি কার্যকর এবং সেই প্রত্যাশায় যে অধীর হয়েছিল সামরিক জান্তা তার চকিত প্রকাশ দেখি সামরিক কর্তৃপক্ষের প্রিয়ভাজন ইরানি সাংবাদিক আমির তাহেরির ভাষ্যে। রটনা হিসেবে হলেও তাহেরি উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকেন নি যে, কারাগারে শেখ মুজিব নাকি উন্মাদ হয়ে গেছেন আর দিনভর দুর্বোধ্য ভাষণ দিয়ে চলেছেন। একই বিকৃত মানসের সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটিয়ে ইয়াহিয়া খান স্বয়ং বলেছিলেন, কারাগারে দিনে অন্তত ডজনখানেক গালগপ্পো করছেন মুজিব, কথার তুবরি ছােটাচ্ছেন। এই দুই ভাষ্যের সত্য-মিথ্যা বিচার করে কোনাে রায় দেন নি লেখক। বরং আমরা দেখি অন্যত্র তিনি উল্লেখ করেছেন আরেক তথ্য, কারাগারে মুজিব সর্বদা প্রশান্ত ভাব বজায় রাখতেন, অন্তরের অস্থিরতার কোনাে প্রকাশ যেন কারা-কর্তৃপক্ষ দেখতে না পান, সে বিষয়ে ছিলেন সজাগ। পালাবদলের প্রহরীদের অথবা খাবার নিয়ে আসা রক্ষীর । সালামের উত্তর দেয়া ছাড়া তিনি সবসময় মৌনতা অবলম্বন করে চলতেন। অপরদিকে বন্দির আচার-আচরণ ও প্রতিটি কথা ইসলামাবাদে রিপাের্ট করার কড়া নির্দেশ ছিল ইয়াহিয়ার। এমনি বক্তব্যের আলােকে পূর্ববর্তী তথ্যের অসারতা বুঝে নিতে কারাে পক্ষে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর এই নিঃসঙ্গ ও একক লড়াইয়ের পুরাে মহিমার পরিচয় এখনাে আমরা পাই নি। তবে আহমেদ সালিমের বইয়ে তাঁর ইঙ্গিতগুলাে যে আমরা পাই, সেটা এক বড় পাওয়া। পরিশেষে একটি সতর্কতার প্রয়ােজন সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। যে-কোনাে রচনাতেই লেখকের বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির ছায়াপাত দুর্নিরীক্ষ্য নয়। বর্তমান রচনাও এ-ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী নয়। পাকিস্তানের রাজনীতির উত্থান-পতনের উত্তাল ধারায় লেখক ভুট্টোকে শেষবিচারে বিবেচনা করে থাকেন সামরিক শাসকদের দ্বারা ফাঁসিতে ঝােলানাে রাজনীতিবিদ হিসেবে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রতি তাঁর প্রীতির কিঞ্চিৎ প্রকাশ বর্তমান রচনাতেও লক্ষ্য করা যায় এবং সেটা মূল্যায়নের দায়িত্বও বর্তাবে পাঠকের ওপর। এছাড়া বেশকিছু বক্তব্য গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে যেখানে ভাষ্যদাতার ব্যক্তিগত অবস্থান ও ঘটনাবিচার মুখ্য হয়ে উঠেছে। আমির তাহেরির রচনা অথবা এয়ার মার্শাল জাফর চৌধুরীর বয়ানের ফাঁক-ফোকরগুলাে যুক্তিবাদী পাঠক সহজেই ধরে নিতে পারবেন। এমনি বয়ান গ্রন্থে আরাে কিছু যে রয়েছে সেটার উল্লেখই আশা করি যথেষ্ট বিবেচিত হবে।