"অভিশপ্ত নগরী" বইটির ফ্ল্যাপের কথাঃ জেরুযালেমকে কেন্দ্র করে “অভিশপ্ত নগরী” উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে। কিন্তু এর কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুতে রয়েছে ইহুদী জাতির পতনের সময়কার তার সমাজব্যবস্থা, ধর্ম, রাজতন্ত্র এবং সর্বোপরি রাজতন্ত্র ও পুরোহিততন্ত্রের মধ্যে বিরোধের নিগূঢ় ভাষ্য। ইহুদী জাতি কালের আক্রমণে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে দেশে দেশে সমুদ্রের মধ্যে ক্ষুদ্র দ্বীপের মত এক স্বতন্ত্র জগৎ গড়ে তুলেছে। বস্তুত ইহুদীদের ঐ দ্বৈপায়ন চরিত্র অনুধাবন তাবৎ বাইবেলের নির্যাসকে আত্মস্ত করা থেকেই সম্ভব। উপন্যাসের চরিত্র চিত্রণে এখানেই লেখকের কৃতিত্ব। “অভিশপ্ত নগরী” যিরূশালেমের পতনের ওপর দাঁড়িয়ে শুধু একখানি ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। এখানে ইহুদী সমাজের ধারাবাহিক ট্র্যাজেডির পেছনে সমাজের কোন কোন শক্তি কিভাবে কাজ করেছে; রাজতন্ত্র ও পুরোহিততন্ত্রের মধ্যে ক্ষশতার দ্বন্দ্ব; ধর্মের আচার অনুষ্ঠানসর্বস্ব অন্তঃসারহীনতার বিরুদ্ধে বিবেকের বিদ্রোহ-এখানে যা নবী যেরেমিয়ার প্রত্যাদেশে উচ্চারিত; সংক্ষেপে রাজতন্ত্র, পুরোহিততন্ত্র ও নবী-এই ত্রিমুখী সংঘাত ইহুদী সমাজের বৈশিষ্ট্য-তার নিখুঁত বিশ্লেষণ এখানে সমুপস্থিত।
পাপের সন্তান বইটির ভূমিকা: ‘পাপের সন্তান’ কে আমার ‘অভিশপ্ত নগরী’ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড বলা চলে।এই দুটি উপন্যাসের ঘটনা-কালের ব্যবধান অর্ধশতাব্দীর কিছু উপর। ‘অভিশপ্ত নগরী’ উপন্যাসের শেষাংষ জেরুজালেম নগরীর পতনের কথা বর্ণিত হয়েছে। এ পতন সাধারণ পতন নয়, বাবিলরাজ নেবুকাডনাজার জেরুজালেমকে ধ্বংস্তূপে পরিণত করে দিয়ে নগরীর নাম নিশানা নিঃশেষে মুছে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, স্ত্রী-পুরুষ-নির্বিশেষে নগরবাসীর ইহুদীদের রজ্জুবদ্ধ পশুর মত তাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন বাবিলে। দীর্ঘকাল ধরে সেখানে তাদের নির্বাসিত জীবন যাপন করতে হয়েছিল। ইহুদী জাতির ইতিহাসে এ একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়।
কালের চক্রে পাশার দান উল্টে গেল। পারসিকদের আক্রমণে বিশ্ব-বিশ্রুত মহাপরাক্রমশালী বাবিল সাম্রাজ্যের পতন ঘটল। বাবিল আর বাবিল সাম্রাজ্যভুক্ত এলাকা পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। বাবিলের নির্বাসিত ইহুদীরা নিজ ভূমি জেরুজালেমে ফিরের যাবার অনুমতির জন্য আবেদন-নিবেদন করে চলল। অবশেষে পারস্যরাজ তাদের এই প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন এবং তাঁর ইহুদী পানপাত্রবাহক নেহেমিয়াকে জেরুজালেমে তীরশথ বা শাসনকর্তা নিযুক্ত করে পাঠালেন। তীরশথ নেহেমিয়ার নেতৃত্বে ইহুদীর জেরুজালেমের বিধ্বস্ত প্রাচীর নুতন করে গড়ে তুলল। কাজটা সহজ ছিল না। পারাস্যরাজ্যের স্থানীয় রাজকর্মচারীরা ও প্রতিবেশী পরজাতীয়েরা ইহুদীর -বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে এই কাজে বাধা দেবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের সমস্ত বাধা অতিক্রম করে গড়ে উঠল নতুন জেরুজালেম নগরী।
ইহুদী জনসাধারণের প্রাণপাত প্রচেষ্টায় নতুন জেরুজালেম গড়ে উঠল বটে, কিন্তু ধর্মোন্মাদ ইহুদী সমাজপতিদের ধর্মের গোঁড়ামি, কঠিন রক্ষণশীল মনোভাব ও তীব্র পরজাতিবিদ্বেষ সমাজকে এক আত্নধ্বংসী আবর্তের দিকে ঠেলে নিয়ে চলল।শাস্ত্রীয় বিধান মানবিকতাকে গ্রাস করে চলল-ধর্মীয় অন্ধতার বেদীমূলে নিষ্পাপ , নিষ্কলঙ্ক ‘পাপের সন্তান’রা বলি হতে লাগল। দুর্ভাগ্য ইহুদী সমাজকে এজন্য ভবিষ্যতে বড় কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিল-ইতিহাস যার সাক্ষী।