“আমস্টারডাম ডায়েরি এবং অন্যান্য" বইটির ফ্ল্যাপ এর লেখাঃ পশ্চিম ইউরােপের সমুদ্র পাড়ের ক্ষুদ্র দেশ হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম। প্রায় সাতশ বছর পুরনাে এই ওলন্দাজ শহরে শাহাদুজ্জামান পড়াশােনার সূত্রে কাটিয়েছেন বছরখানেক। শাহাদুজ্জামান এ সময়ের একজন অন্যতম কথাসাহিত্যিক। তিনি যখন ভিনদেশী একটি শহরে বসবাসের অভিজ্ঞতার কথা লেখেন সেটি নিছক একটি ভ্রমণ বৃত্তান্ত থাকে না, পেয়ে যায় ভিন্নতর। মাত্রা। হিম, জলজ, বৃষ্টিমুখর আমস্টারডাম শহরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঔপনিবেশিকের ইতিহাস, আছে ভ্যানগগ, রেব্রান্ট....। আনা ফ্র্যাঙ্কের মতাে কিংবদন্তি নাম। কালাে গাভীর দুধ, ফুটবল, দিগন্তব্যাপী টিউলিপ ফুলের বাগান, আকাশের গায়ে উইন্ডমিলের পাখা কিংবা বৃহত্তম যৌন বিনােদন কেন্দ্রের আকর্ষণ পৃথিবীব্যাপী পর্যটকদের টেনে আনে এ শহরে। কিন্তু শাহাদুজ্জামান এ শহরের কেবল ঐ পর্যটক উপাদানের বিষয়ে লেখেননি, লিখেছেন এ শহরের আটপৌরে জীবনকে নিয়েও। তিনি বুঝতে চেয়েছেন এ শহরের জৌলুস এবং ক্লান্তিকে, ঘনিষ্ঠ হয়েছেন এ শহরে বসবাসকারী বাংলাদেশসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের সঙ্গে, জানতে চেয়েছেন তাদের আনন্দ, বেদনা, স্বপ্নের। কথা। এ ছাড়াও শাহাদুজ্জামান বেইজিং, হ্যানয়, রেঙ্গুন, কাঠমুন্ডুর মতাে উল্লেখযােগ্য কয়েকটি এশিয়ান শহরে ভ্রমণ করেছেন। তিনি এ বইয়ে সেসব শহরের অভিজ্ঞতার কথাও লিখেছেন। আমস্টারডাম ডায়েরি । এবং অন্যান্য তাই একজন সংবেদনশীল লেককের একটি নতুন ভূগােল, একটি নতুন সংস্কৃতি, অগণিত নতুন মানুষের মুখােমুখি হওয়ার অভিঘাতের বর্ণাঢ্য বিবরণ।
সমসাময়িক বাংলা কথাসাহিত্যে মননশীল সাহিত্যিক হিসেবে শাহাদুজ্জামানের অবস্থান অনন্য ও অগ্রণী। গল্প, উপন্যাসেই বেশি পরিচিত হলেও শাহাদুজ্জামানের উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে প্রবন্ধ, অনুবাদ, ভ্রমণ এবং গবেষণার ক্ষেত্রেও। লেখকের মতে, তিনি আল বেরুনীর মতো দীর্ঘ নয়, বরং বিস্তৃত জীবনের আকাঙ্ক্ষা করেন। ১৯৬০ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন কথাশিল্পী শাহাদুজ্জামান। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেন মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রকল্পে। উচ্চতর শিক্ষার জন্য পরবর্তীতে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং নেদারল্যান্ডসের আমস্টার্ডাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে শাহাদুজ্জামান দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ বিভাগে। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও গবেষণা কাজের সাথে যুক্ত রয়েছেন। পারিবারিকভাবে সাহিত্যের যে ঘোর শৈশবেই আচ্ছন্ন করেছিলো তা-ই শাহাদুজ্জামানের সাহিত্যিক হয়ে ওঠার পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৯৬ সালে মাওলা ব্রাদার্স আয়োজিত কথাসাহিত্যের পান্ডুলিপি প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়ে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম ও ছোটগল্পগ্রন্থ ‘কয়েকটি বিহ্বল পাখি’। শাহাদুজ্জামান এর বই সমূহ ঠিক প্রচলিত উপন্যাসের গৎবাঁধা আঙ্গিকে ধরা যায় না। অনেক সাহিত্যবোদ্ধা তাই তাঁর লেখাকে ফিকশন-নন ফিকশন, পদ্য-কথাসাহিত্য, সবকিছুর মিশেলে ‘ডকু ফিকশান’, আবার অনেকে ‘মেটাফিকশান’ বলে রায় দিয়ে থাকেন। শাহাদুজ্জামান এর বই সমগ্র এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্রাচের কর্নেল, আধো ঘুমে ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে, একটি হাসপাতাল একজন নৃবিজ্ঞানী কয়েকটি ভাঙ্গা হাড়, ক্যাঙ্গারু দেখার শ্রেষ্ঠ দিন এবং অন্যান্য অনুবাদ গল্প, কয়েকটি বিহ্বল গল্প, মামলার সাক্ষী ময়নাপাখি, কাগজের নৌকায় আগুনের নদী, এবং কবি জীবনানন্দ দাশের উপরে লেখা উপন্যাস ‘একজন কমলালেবু’। কমলা রকেটসহ বেশ কিছু চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও রচনা করেছেন শাহাদুজ্জামান। ২০১৬ সালে বাংলা কথাসাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পান বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।