ভূমিকা গীতা এমনি একখানি গ্রন্থ; যাহার প্রয়োজনীয়তা জীবের পূর্ণ না হওয়া পর্য্যন্ত থাকিবেই। এই প্রাচীন বয়সে সেই জন্য আর একবার গীতা বুঝিতে প্রয়াস পাওয়া যাইতেছে। কে বলিবে ইহা .শেষ প্রয়াস কি না? ভগবান্ বাল্মীকি রামায়ণ লিখিয়া পূর্ণ হইয়া গিয়াছিলেন ৷ ব্রহ্মা ভগবান্ আসিয়া যখন বাল্মীকিকে বলিলেন, ব্রহ্মন্ আমি মহাভারত নামক পরম পবিত্র পুরাতন ইতিহাস তোমার জন্য সম্যরূপে কল্পনা করিয়া রাখিয়াছি—“প্রকল্পিতং ময়া সম্যক্ তব শ্লোকয় তন্মনে” তুমি তাহা শ্লোক বদ্ধ কর— তখন ভগবান্ বাল্মীকি বলিলেন “কৃতং রামায়ণং ব্রহ্মন্ ব্যক্তং মোক্ষস্য সাধনম্” আমি রামায়ণ রচনা করিয়াছি—রামায়ণ স্পষ্টভাবে মোক্ষের সাধন। আর রামায়ণ রচনা করিয়া আমি নিঃসন্দেহে ক্ষোভ মোহ বিবর্জ্জিত হইয়াছি। “কিমর্থমপরং ব্রহ্মন্ করিষ্যামি বৃথোদ্যমম্” আমি কি জন্য আর বৃথা উদ্যম করিব? “অহং রামায়ণং কৃত্বা কৃতার্থোহভবমীশ্বর!” হে ঈশ্বর! আমি রামায়ণ রচনা করিয়া কৃতার্থ হইয়া গিয়াছি—পূর্ণ হইয়া গিয়াছি। দ্বাপরে ব্যাস জন্মিবেন—তাঁহাকে আমি কাব্যবীজ বলিয়া দিব, তিনি আপনার বাসনা পূর্ণ করিবেন। আজকালকার জগতে কত লোক কত গ্রন্থ রচনা করিতেছেন—কত প্রকারের কল্পনা জগতকে ছাইয়া ফেলিতেছে, কিন্তু কয়জন আজ বাল্মীকির মত বলিতে পারিয়াছেন—আমি পূৰ্ণ হইয়া গিয়াছি—আর লিখিবার প্রয়োজন নাই—আমার নিজের জন্যও নাই—অপরের জন্যও লিখিবার কিছুই নাই—ধৰ্ম্মার্থকাম-মোক্ষের সমস্ত কথাই আমি বলিয়াছি। হায়! আমাদেরও ত এই দশা। আমরা অপূর্ণই থাকিয়া যাইতেছি সেই জন্য এত লিখিয়াও মনে হইতেছে সব ত লেখা হইল না, এত করিয়াও মনে হইতেছে সব ত করা হইল না। হায়! কি দুৰ্ভাগ্য! চক্ষু এত দেখিল—তথাপি ইহার দেখার সাধ মিটিল না—ইহা পূর্ণ হইয়া গেল না। কর্ণ এত শুনিল—ইহা পূর্ণ হইয়া কিন্তু গেল না। হায়! সেই পূর্ণকে না দেখা পর্যন্ত—সেই পূর্ণের শ্রীমুখের কথা সাক্ষাতে শোনা না পৰ্য্যন্ত বুঝি ইন্দ্রিয়াদি পূর্ণ হইবে না। এই জন্য আমাদের এত কৰ্ম্ম, এত বচন, এত দেখাশুনা, এত গমনাগমন। আহা! পূর্ণ হইয়া গেলে তবে সব করা ফুরাইয়া যায়। পূর্ণ হইয়া গেলেও কিছু করাটা অভিনয় মাত্র—পূর্ণের অপূর্ণ সাজিয়া অভিনয়। শ্রীগীতা মানুষকে পূর্ণ করিবারই গ্রন্থ। কিরূপে শ্রীগীতা মানুষকে পূর্ণ করিবার পথ দেখাইয়া দিতেছেন তাহা বুঝিবার জন্যই এই আয়োজন।