আমার জন্মের পরে মায়ের চাকরির সুবাদে আমরা নানাবাড়িতেই থাকতাম। সেখান থেকে যখন বাবার কর্মস্থলে মা ট্রান্সফার হলেন, তখন আমার বয়স দুবছর হবে। অনেক লোকজনের মধ্য থেকে একা একা আমাকে নিয়ে আম্মু চলে এলেন। তখন আমি নাকি রাতে চিৎকার করে উঠতাম, আর প্রচন্ড ভয় পেতাম। ওই বয়সের স্মৃতি কারো মনে থাকার কথা নয়, আমারও মনে নেই, তবে একটা দৃশ্য মনে আছে। একটা মেয়ে হাতির মত মুখোশ পড়ে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। দরজা ঠেলে মেয়েটার ঘরে ঢোকা আমি এখনো কল্পমায় স্পষ্ট দেখতে পাই।
যাই হোক, এই ভয় কাটলো আমার একসময়। ওই সময়ে একজন হুজুর ছিলেন ওই এলাকায়। আলেম ব্যক্তি। তিনি দোয়া পড়ে দিয়েছিলেন।
সেই হুজুরের মৃত্যুটা খুব অস্বাভাবিক ছিল। একদিন সকালে, তখনো আলো ফোটেনি, তিনি উঠেছেন ওজু করতে। পুকুরঘাটে বসে দেখলেন, একটা দশ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মানুষের ছায়া হাতে কুড়াল টাইপের কিছু একটা নিয়ে হেটে যাচ্ছে। তিনি প্রচন্ড ভয় পেলেন। হেলুসিনেশন বলা যেত, কিন্তু সেদিনই দুজন লোক এসে হুজুরের কাছে দোয়া পড়া পানি নিতে এসে এই ঘটনা বললেন। হুজুর তাদের পানি দিলেন কিন্তু নিজে বললেন, আমাকে কে দোয়া পড়ে দেবে! প্রচন্ড ভয় থেকে হুজুরের জ্বর হয় এবং তিনি মারা যান এই জ্বরেই।
আমি প্রচন্ড ভীতু মানুষ। একা ঘুমাতেও ভয় পাই, লাইট নেভাতে পারি না। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকার সময় আমি হরর বই পড়া শুরু করি। বিদেশী হরর গল্প আমার ভাল লাগত না। বিদেশি গল্প মানেই হয় জম্বি নয় ওয়ারউলফ। খুবই হাস্যকর লাগে, পূর্নিমা রাতে একজন মানুষ উলফ হয়ে যায়, একজনকে কামড় দেয়, সেও হয় মারা যায় নয়তো উলফ হয়ে যায়! আরো আছে, একজনকে তার প্রিয় কেউ কাটাকুটি করে খেয়ে ফেলে। এগুলো পড়তে আমার গা গুলিয়ে আসে। তার চাইতে দেশী গল্প গুলি বেশি আতংকের। আমার জন্য আমার বাবা ৯৫ সালের দিকে একটা বই কিনে আনেন, তার নাম "শ্রেষ্ঠ ভূতের গল্প"। পশ্চিম বাংলা আর বাংলাদেশের লেখকদের হরর সংকলন। সেখানে একটা গল্প ছিল " পানিমুড়ার কবলে", সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা মনে হয়।সেই গল্প পড়ে আমি দুপুরে পুকুর পাড়ে যেতে ভয় পেতে শুরু করি। নির্জন পুকুর দেখলে আমার মনে হয় এখনি টাক মাথার কেউ উঠে আসবে।আর একটা গল্প ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, নাম মনে নেই, কিন্তু পুরোনো কবর দেখলে আমি তখন থেকে ভয় পাই! এর পর আব্বু আবার কিনে দেয় ইমদাদুল হক মিলন স্যারের লেখা "ভুত গুলো খুব দুষ্ট ছিল"। তখন আমি বড় মাঠ দেখলেই ঘুমঘুমির মাঠ মনে করতে শুরু করলাম। গভীর রাতে "কুউ" করে কোন পাখি ডেকে উঠলে আমার কু পাখির কথা মনে হয়। গায়ের পশম দাড়িয়ে যায়, শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের অনুভুতি শিরশির করে বয়ে যায়। এরপর ভয়ের গল্প সেভাবে পড়িনি। হঠাৎ করেই হলে বান্ধবী রুম্পার কাছে হরর সংকলন পেয়ে পড়া শুরু করি। আবার ভয় পাওয়া শুরু হয়। আমি যে ব্লকে ছিলাম, বৃহস্পতিবার সে ব্লক ফাঁকা হয়ে যেত, আমি একা থাকতাম, রাতে বাথরুমে যাবার সময় আমার মনে হওয়া শুরু হলো আমার পিছনে পিছনে কেউ আসছে। তার স্লিপ প্যারালাইসিস তো আছেই। মানে সোজা বাংলায় যাকে বলে "বোবায় ধরা"। রাতে ঘুম আর জাগরনের মাঝে আমার মনে হতো আমি ভাসছি, কেউ একজন আমাকে টেনে মাথার কাছে টেবিলের নিচে নিয়ে যাচ্ছে। আমি জানা সব দোয়া পড়তাম ঘুমের মাঝেই। অদৃশ্য কারো সাথে ভেসে ভেসে টানা হ্যাচড়া চলতো আমার। একজন হুজুরের সাথে কথা বললাম, জানতে পারলাম এটা কোন দুষ্ট জ্বীনের কাজ। খুবই হাস্যকর। বিশ্বাস করে তাবিজ পরলাম কিছুদিন। তাবিজ পরলে আমার মাথা ঝিমঝিম লাগতো, তাই খুলে ফেললাম। মানে সাথে রাখতে পারলাম না। এরপর এর গল্পটা আসলে ব্যাখ্যার অতীত। ২০১২ সালে একটা বই পড়ি, "প্রেত"নামের। কিন্তু ২০১৩ সালে বইমেলায় গিয়ে আমি অনেক বইয়ের সাথে এই বইটিও কিনে ফেলি। সেটা হতেই পারে, কিন্তু সমস্যা হয় কিছুদিন পরে নীলক্ষেত থেকে আমি আবার ওই বইটিই আবার কিনি। বাসায় এসে দেখি আমার একি বই দুটি। এর পরের বছরও আমি বইমেলা থেকে আমি ওই বইটিই আবার কিনে আনি!! কেন যে একই ভুলটা বারবার হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম নাহ। কাউকে বললে সে হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছিল। এরপর ভয় পাওয়া শুরু হলো। কারনে অকারণে ভয় পেতাম রাতে, রাতে ঘুমের মাঝে মনে হতো বারান্দায় কেউ দাড়িয়ে আছে। দরজা লক না করে ঘুমাতে পারতাম না।
আমরা অনেকে মনে করি প্যারানরমাল গল্প মানে শুধুই গল্প, সেটা কিন্তু সব সময় নয়। প্রকৃতির সব রহস্য কি আমরা জানতে পারি????? একটু অস্বাভাবিক ঘটনা গুলো আমাদের জানতে ইচ্ছে করে। এবার ইদে আশিক বাড়িতে এসেছে ভেঙে ভেঙে। রাত আড়াইটার কিছু পরে পোলেরহাট বাজার থেকে এগিয়ে একটা জায়গায় দেখে এক মহিলা একটা বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন জনমানবহীন জায়গায় বিষয়টি প্রচন্ড অস্বাভাবিক। এই অভিজ্ঞতা আমি লিখেছি একটি গল্পে।
আমার স্কুল লাইফ কেটেছে বাবার কলেজ কোয়ার্টারে। বেশিরভাগ ভয়ের গল্পগুলি আমাদের কলেজ কোয়ার্টারে থাকার সময় শোনা। তখন রোজ দুইঘন্টার লোডশেডিং হতো নিয়মিত। রোজ সন্ধ্যায় বসতো জমজমাট গল্পের আসর। আমি প্রচুর বই পড়ি, তার একটা বড় অংশ প্যারানরমাল স্টোরিজ। "চন্দ্রাহত" বইয়ের গল্প গুলো সব পুরোপুরি গল্প নয়, অনেকের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। বিভিন্ন সময়ে শোনা গল্পগুলো নিজের মতো করে সাজিয়েছি। আছে অনুবাদ স্টাইলে লেখা কয়েকটি মৌলিক গল্প।
শানজানা আলম, লেখালেখির অভ্যাস বাবার কাছ থেকে পাওয়া। তিনি গল্প বলেন, নিজের চারপাশের কথাগুলোই লিখে দৃশ্যমান করার চেষ্টা চলে অবিরাম। বর্তমানে সোস্যাল মিডিয়ায় নিজের টাইম লাইন এবং বিভিন্ন গ্রুপে তার গল্পগুলি বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রফেসর বাবা এবং স্কুল শিক্ষিকা মায়ের বড় এবং একমাত্র মেয়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে এখন সময় কাটে লেখালেখি নিয়ে। স্বামী মোঃ আশিকুজ্জামান এবং একমাত্র মেয়ে আফশীনকে নিয়ে তিনি ঢাকাতে থাকেন।