'পথের পাঁচালী'র কাহিনী বা আখ্যান সহজ গাল্পিকতার দ্বারা আবেশিত নয়। এখানে বর্ণনা ও বিশ্লেষণ এতোটা গভীর ও মর্মভেদী যে সহজভাবে গল্পের বয়ান সরল পথে অগ্রসর হতে পারেনি। ফলে আখ্যানধর্সিতায় এর কাহিনী শ্লথ ও শিথিল হয়ে পড়েছে। আর সেখানে কাহিনীর চেয়ে বর্ণনার আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। তথাপি এ উপন্যাসের কাহিনী বর্ণনার আবেগ ও বিস্তারিত চিত্রকুশলতা ছাড়িয়ে একটা রূপ পরিগ্রহ করে। নিচে উপন্যাসের আখ্যান সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপিত হলো: নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে হরিহর রায়ের বাস। তার রয়েছে ক্ষুদ্র কোঠাবাড়ি। সেখানে পারিবারিক সদস্য বলতে রয়েছে দূর সম্পর্কীয় দিদি ইন্দির ঠাকরুণ, স্ত্রী সর্বজয়া, মেয়ে দুর্গা ও পুত্র অপু। হরিহরের পিতৃনিবাস ছিল যশড়া-বিষ্ণুপুরে। তার পিতা রামচাঁদ রায় বিপত্মীক হবার পরে নিশ্চিন্দিপুরে দ্বিতীয় দার পরিগ্রহ করেন। তিনি নিজ গ্রাম ছেড়ে এসে এই নিশ্চিন্দিপুর শ্বশুরের গ্রামে বাস করতে থাকেন। পিতা রামচাঁদ রায়ের মৃত্যুর পর হরিহর অনেক সংগ্রাম ও কষ্টের ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠে। তার বেঁচে থাকার সঙ্গে একটি ইতিহাস প্রযুক্ত। বীরু রায় ছিল হরিহরের পূর্বপুরুষ। ডাকাতি ছিল তার পেশা। সে প্রথমে মানুষ খুন করতো এবং তারপর করতো অর্থসন্ধান। একদিন ডাকাতি করবার সময় সে এক ব্রাহ্মণ ও তার পুত্রকে হত্যা করে। এ ঘটনার পরের বছরে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরার পথে বীরু রায় তার পুত্রকে হারায় এবং কিছুদিনের মধ্যে সে নিজেও মারা যায়। সেই থেকে এ বংশে জ্যেষ্ঠ পুত্র বাঁচতো না। হরিহরেরও বাঁচার কথা ছিল না। তার মা সন্ন্যাসীর কাছে কাঁদাকাটি করে একটি মাদুলি পান। মাদুলির গুণেই হোক বা ব্রহ্মশাপের তেজ দুই পুরুষ পরে কমে যাওয়ার ফলেই হোক-হরিহর বেঁচে থেকে সংসারকর্ম নির্বাহ করছে।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।