ময়নাঢিপির কথকতা কৃষকের জীবনগাথার এক চিরন্তন খ-চিত্র। ভূমির আদলে গড়ে ওঠা নারী কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার প্রাণ। মাটি ছেনে বেঁচে থাকা কৃষককন্যা মাটির মতোই কোমলপ্রাণ, সর্বংসহা। সম্পদে-বিপদে, সুযোগে-দুর্যোগে তারা আগলে রাখতে চায় সমাজকে। তারা ধর্ষিত হয়, পীড়িত হয়, কলঙ্কিত হয়; আবার পঙ্কিলতার মাঝে তারাই ফুটিয়ে তোলে পদ্ম। ছেঁড়া আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখতে চায় জগতের সমস্ত তুচ্ছতাকে। পুরুষ যেখানে পরান্মুখ, নারী সেখানেই জেগে ওঠে তার সর্বগ্রাসী শক্তি নিয়ে। কৃষিভিত্তিক সমাজনির্ভর ময়নাঢিপির কথকতা’য় কৃষক, ফসল এবং প্রকৃতির মধ্যকার সেই শাশ্বত সম্পর্কই নিরূপিত হয়েছে, তবে একটু ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। অপরিণামদর্শী সরল চাষি অন্নাভাবে শুকিয়ে মরবে জেনেও একটুখানি আনন্দলাভের জন্য নিজের সর্বস্ব ব্যয় করতে কুণ্ঠিত হয় না। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কিছু অংশপটও এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। ফসলের হানি দেখে যে চাষিকন্যার চেতনালুপ্তি ঘটে, হিংস্রপশুর সামনে তাকেই আমরা দাঁড়াতে দেখি প্রচ- শক্তি নিয়ে। ‘মিছিলের অগ্রভাগে ছুটছে নন্দা। হরনাথ বারুইয়ের অনূঢ়াকন্যা অলোকনন্দা। কী টকটকে লাল তার দুটি চোখ!’ ভূমিকা কৃষক পরিবারে জন্ম হওয়ার কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে ধানের কথা কিছু লিখে রাখা উচিত ভেবেই কাগজ নিয়ে বসেছিলাম। আসলে উপন্যাস লেখার চিন্তা তখন মাথায় আসেনি। আর এটা ঠিক উপন্যাস হয়েছে কি না তাও জানি না। ছোটবেলায় গৌরদাদুর কাছে গল্প শুনতামÑ একটা ঘটনার সাথে আরেকটা জুড়ে তিনি মুখে মুখে কেমন গল্প বানিয়ে দিতেন! পাঠ করে যেতেন আমাদের ধানের পাঁচালি। পরে শুনেছিলাম এগুলোকে নাকি কথকতাও বলা যায়। ময়নাঢিপির কথকতা’য় কৃষিনির্ভর সমাজের খ- খ- গল্পকে জুড়ে দেওয়ার প্রচেষ্টামাত্র করা হয়েছে। ময়নাঢিপি আসলে কোনো বিশেষ গ্রামের নাম নয়। আমার মনে হয় কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্র একেকটা ময়নাঢিপি লুকিয়ে আছে। সোনারঙের ধান আর সরল চাষির প্রাণ একসূত্রে গাঁথা। পেশাগত জীবনে কিছু পরিবর্তন এবং বৈচিত্র্য এলেও ধানের গন্ধ চাষিমনে আজও যে আনন্দের উদ্রেক করে, অন্যকিছুতে তা সম্ভব নয়। ময়নাঢিপির কথকতা মূলত নারী, মাটি আর ধানের কথকতা। পূজা মিত্র ১৯.০৯.১৯