বইটির অনুবাদকের কথাঃ বড়লাট লর্ড মেয়াে (জানুয়ারী, ১৮৬৯-১৮৭২) স্যার উইলিয়াম হান্টারকে ভারতীয় মুসলমানরা মহারানীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে ধৰ্মত বাধ্য কিনা, এই প্রশ্নটি সম্বন্ধে অনুসন্ধান আলােচনা করে একটি রিপাের্ট দানের নির্দেশ দেন। ব্রিটিশ সিভিলিয়ান স্যার হান্টার শাসক জাতির দৃষ্টিভঙ্গিতে এ সম্পর্কিত তথ্যসমূহ অনুসন্ধান ও আলােচনা করে যে পুস্তিকা প্রণয়ন করেন, তা-ই 'The Indian Musalmans' নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, পুস্তকখানি লেখা হয়েছিল একজন ইংরেজ কর্তৃক শাসক ইংরেজ জাতির কার্যকলাপের সাফাই হিসেবে এবং মুসলিম আযাদী যােদ্ধাদের কার্যসমূহ বক্রদৃষ্টিতে লক্ষ্য করে সে সবের তীব্র নিন্দা করার উদ্দেশ্য নিয়ে; তবু পুস্তকখানির ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে সদ্য রাজ্যহারা ও শাসন বিষয়ে সর্ব অধিকারবঞ্চিত ভারতীয় মুসলিমদের অন্তর্জালা এবং স্বতশক্তি পুনরুদ্ধারের মানসে অবিরাম আপােসহীন সংগ্রাম ও সাধনার সুস্পষ্ট চিত্র। পুস্তকখানির প্রথম অধ্যায় বর্ণিত হইয়াছে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তস্থিত মুজাহেদীন ছাউনি সিত্তানা ও মুলকার মুজাহিদদের সঙ্গে ইংরেজদের সংগ্রাম-সংঘাত এবং ইংরেজদের বার বার শােচনীয় পরাজয়ের পর শেষে ভেদনীতি ও কূটচালের আশ্রয় নিয়ে মুজাহিদ বাহিনীর ধ্বংস সাধন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে জিহাদী সংগঠনের বিবরণ, যার মারফতে বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ভারতের অভ্যন্তরীণ প্রদেশসমূহ থেকে অজস্রভাবে মানুষ ও টাকা পয়সা জিহাদী বসতিতে আমদানি হতাে। তৃতীয় অধ্যায়ে আলােচিত হয়েছে জিহাদ করা জায়েজ কিনা; এই তর্কিত প্রশ্নে আলেম সমাজ ও নব্য শিক্ষিত সমাজের সমালােচনা; আর চতুর্থ ও শেষ অধ্যায়ে আলােচিত হয়েছে। ইংরেজ শাসনে মুসলমানদের প্রতি অবিচারগুলির এবং শাসক-মনােভাবসুলভ প্রতিকারের উপায়। সমকালীন মুসলমান, বিশেষত বাঙালী মুসলমানদের ধর্মীয়, আর্থিক, শিক্ষাগত, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে এই অধ্যায়ের মূল্য ও রুত্ব অনেকখানি। গ্রন্থটির ১৮৭১ সালে প্রথম ও ১৮৭৬ সালে শেষ মুদ্রণ হয়েছিল। ১৯৪৫ সালে আমারই প্রচেষ্টায় 'The Comrade Publishers' কর্তৃক বইখানি পুনর্মুদ্রিত হয়। তখন থেকে আমি তার বাংলা অনুবাদ করতে থাকি ও মাসিক সওগাত’-এ চতুর্থ অধ্যায়ের কিছু অংশ প্রকাশ করি। ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক দিয়ে গ্রন্থখানির মর্যাদা অনেক এবং এ জন্যেই বাংলাভাষী মুসলমানদের তার সংগে পরিচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। গ্রন্থখানিতে যা কিছু মতামত ব্যক্ত হয়েছে, সবই হান্টার সাহেবের নােটে আমার নিজৰ মতামত (অ) উল্লেখে চিহ্নিত হয়েছে। আর একটি কথা; লেখক ভারত বলতে তদানীন্তন ব্রিটিশ শাসিত বর্তমান বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশকে বুঝিয়েছেন।
বিচারপতি আবদুল মওদুদ একজন সুসাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে তার মধ্যে অনুসন্ধানী মন থাকায় তিনি ইতিহাস চর্চায় প্রবৃত্ত ছিলেন। বিশেষ করে ইসলামের ইতিহাস,তার দর্শন চিন্তা, সভ্যতা ও সংস্কৃতিমূলক রচনায় তিনি মনােনিবেশ । করেন। আবদুল মওদুদ ১৯০৮ সালে বর্ধমান জেলার খণ্ডকোষ থানার ওয়ারী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস শাস্ত্রে বি.এ.(অনার্স) সহ এম.এ.পাস করেন। ১৯৩২ সালে এল.এল.বি. ডিগ্রী অর্জনের পর ১৯৩৩ সালে বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের (বিচার বিভাগ) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। একজন দক্ষ সৎ ও একনিষ্ঠ বিচারক হিসাবে সর্বমহলে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ও ১৯৬৭ সালে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় দলের সদস্য হিসেবে যােগদান করেন। এ ছাড়াও তিনি যুক্তরাজ্য, ইরাক সফর করেন। চাকুরী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তাঁর গভীর অধ্যয়নলব্ধ জ্ঞান, বিশ্লেষণ ক্ষমতা ও শক্তিশালী লেখনী তার রচনাসমূহকে সমৃদ্ধ করে তােলে। প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থ ও মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ : সংস্কৃতির রূপান্তর (১৯৬৯), কামেল নবী (১৯৪৭), ইসলাম ইউরােপকে যা শিখিয়েছে (১৯৪৯), মুসলিম মনীষা (১৯৫৫), শাহ আবদুল লতিফ ভেটাই (১৯৬৭), হযরত ওমর (১৯৬৭)। ১৯৭০ সালের ২১ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।