বাউল কবির আরশিনগরের পড়শির সঙ্গে কখনো দেখা হয় না। এটা যদিও সাধনতত্ত্বের রূপক, কিন্তু এতে অন্তর্নিহিত হয়ে আছে প্রান্তজনের সঙ্গে কেন্দ্রজনের অপরিচয় ও দূরত্বের ডিসকোর্স। সমাজে শ্রেণিবিভাজন, ক্ষমতাদ্বন্দ্ব, সাংস্কৃতিক হেজিমনি এবং ভূ-নৃতাত্ত্বিক চারিত্র্যভিত্তিতে দূরাতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত এদেশে বসবাসকারী/বহিরাগত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সর্বদাই রয়ে গেছে নিম্নবর্গ, শূদ্র-দলিত, প্রান্তিকজন, অন্ত্যজ ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, কালে-কালে এদের সঙ্গে সংঘাতদ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে উচ্চবর্গীয় শাসকবর্গ, ধর্মকারবারিরা। সিরাজ সালেকীন রচিত কবিতায় নৃগোষ্ঠী : মূলত কেন্দ্র থেকে দেখা-এই শিরোনামের মধ্যেই সংকেতিত হচ্ছে সেই দ্বন্দ্বের পরিকল্প। বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে মানুষ আর না-মানুষের ঐতিহাসিক-নৃতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক যে ধারা গড়ে উঠেছিল তা বাংলা কাব্যসাহিত্যে রূপান্বিত হয়েছে দুইভাবে। এক. প্রান্তিক নৃগোষ্ঠীকেন্দ্রিক জীবনের পরিসর। দুই. কেন্দ্রে বসবাসরত উচ্চবর্গীয় শ্রেণির অন্তর্গত শিক্ষিতজনের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা প্রান্তের নৃগোষ্ঠীদের জীবনরূপ। সিরাজ সালেকীনের গ্রন্থটির পরিসর সুদূর ঐতিহাসিক-সামাজিক-ধর্মীয় কাল থেকে কালান্তর পেরিয়ে সুদীর্ঘ সময়ের নৃতাত্ত্বিক ধারা বেয়ে একুশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত প্রসারিত। এ এক ব্যাপক পরিশ্রমসাধ্য মেধাবী প্রকল্প। লেখক পরিভ্রমণ করেছেন বাংলা কাব্যের বিপুল এলাকা-চর্যাপদ থেকে বিশ শতকের আধুনিক কবিতা পেরিয়ে একুশ শতকের সূচনাপর্বের কবিতা পর্যন্ত। সিরাজ সালেকীনের ইতিহাসজ্ঞান, নান্দনিক বোধ এবং ব্যাপ্ত পঠনপাঠন নিবেদিত থেকেছে বিশ্লেষণের অন্তর্দৃষ্টিতে, চিরে-চিরে ভেতরের রূপটিকে বের করে আনার কুশলতায়। তিনি উন্মোচন করেছেন কাব্যের দৃশ্যমান ভাববস্তুর অন্তরালবর্তী অন্তর্বস্তুকে। যুক্তিশীল নিবিড় প্রেক্ষণীতে অবলোকন করেছেন বাংলা কবিতার রচয়িতাদের চারিত্র্য, প্রচ্ছন্ন সুবিধাবাদী অবস্থান ও দূরত্ববোধকে। বিপরীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে প্রান্তিকবর্গের জীবনায়ন, দৃষ্টিকোণ ও তাদের elemental force of life-দুর্মর প্রাণশক্তির মৌল সত্য। আমার পাঠের পরিসরে এ রকম গ্রন্থের দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত আর পাইনি। পরিমিত বাচনে, তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণে ও তথ্য-উপাত্তের মিথস্ক্রিয়ায় এই গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যগবেষণায় একটি মাইলফলক। একই সঙ্গে সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞার প্রকাশে এখানে সিরাজ সালেকীন হয়ে উঠেছেন অনন্য। গ্রন্থটির পাঠে বিদগ্ধ প্রগতিশীল পাঠক শুধু নান্দনিক রসাস্বাদেই আপ্লুত হবেন না, তাঁদের ইতিহাসিত জীবনবীক্ষা ও নিজস্ব জ্ঞানভাণ্ডারও সমৃদ্ধ হবে। এমন একটি রচনাকৃতির জন্য গ্রন্থকারের প্রতি রইল আমার আশীর্বাদ ও অভিনন্দন। -অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল
জন্ম ১৫ অক্টোবর ১৯৬৮; কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বারে। পিতা : মোহাম্মদ হোসেন; মাতা : আমেনা খাতুন। শিক্ষা : প্রাথমিক শিক্ষা দেবিদ্বার উপজেলার মডেল ইনস্টিটিউটে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের অধ্যয়ন। উভয় পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা সাহিত্য বিষয়ে বিএ অনার্স (১৯৯১) ও এমএ (১৯৯২)। উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী লাভ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প : জীবনজিজ্ঞাসা ও শৈলী-বিচার’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচডি লাভ (২০০৫)। কর্মজীবন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান, বর্তমানে অধ্যাপক পদে কর্মরত।