রক্ষণশীল সমাজের নানা নিষেধ ও নিগড় পেরিয়ে এ এক সজাগ দরদি মনের এগিয়ে চলার বৃত্তান্ত। তাতে সেই সমাজের ভিতর এবং বাইরের মহলের সমকালীন জীবন প্রাণ পেয়েছে। আর কালের যাত্রায় সমাজের বিবর্তন-রূপান্তরের বাস্তব ও মানসচিত্রও লেখকের সংবেদনশীল মননের স্মৃতির খেয়ায় একালের তটে এসে ভিড়েছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ জুড়ে ইতিহাসের ভাঙাগড়ার সাক্ষী আর জটিল সব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন আবুল ফজল তাঁর আত্মজীবনীতে প্রাঞ্জল বর্ণনায় স্মৃতির ঝাঁপি খুলে আগ্রহী পাঠকের জন্যে উদার হাতে চিন্তার অজস্র রসদ জুগিয়ে গেছেন। আবুল ফজল উনিশ শতকের নবজাগরণেরই ফসল। বাংলাসাহিত্য অধ্যয়ন, এ বিষয়ে অধ্যাপনা এবং চর্চা তাঁর মানসে সংবেদনশীল উদার মানবিক চেতনার শক্ত ভিত দিয়েছে। ছাত্রাবস্থায় বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে যুক্ত হয়ে তিনি অর্জন করেছেন মুক্তচিন্তার প্রণোদনা ও যুক্তিবাদী মানস। এই শিক্ষা তিনি আজীবন লালন করেছেন। রবীন্দ্রসাহিত্য এবং আধুনিক বিশ্বসাহিত্য তাঁর জীবনবোধকে বহুমাত্রিক ও গভীরতর করেছে। নিজ সমাজের পশ্চাৎপদ ভাবনার বেড়ি ভাঙার তাগিদ তাঁর সাহিত্য রচনার পিছনে কাজ করেছে। ১৯৪৭-এ আশাভঙ্গের স্বাধীনতায় প্রাপ্ত দেশ পাকিস্তানের শাসকদের চক্রান্ত ও নিপীড়নের নানা অপকৌশল তাঁকে ক্রমেই যুক্তির ধারালো আয়ুধ চালিয়ে ঋজু দৃঢ় বক্তব্যের প্রবন্ধ রচনায় ব্যাপৃত করেছিল। বায়ান্ন থেকে বাঙালির জাগরণ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সংগ্রামসহ সমকালীন ইতিহাসে জাতির প্রয়োজন মিটিয়ে তাঁকে কলম চালাতে হয়েছে অনবরত। আবুল ফজল সেই থেকে জাতির বিবেক হিসেবে সম্মানিত হয়ে আসছেন।
মননশীল চিন্তাবিদ, শিক্ষাব্রতী, মানবদরদি আবুল ফজলের জন্ম ১৯০৩ সালের পহেলা জুলাই। বাবা মৌলানা ফজলুর রহমান ছিলেন বিজ্ঞ আলেম। ১৯২৩ সালে নিউস্কিম মাদ্রাসা থেকে প্রবেশিকা ও ১৯২৫তে ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯২৮-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. এবং ১৯২৯-এ ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি পাস করেন। এগার বছর পর ১৯৪০-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. পাস করেন। স্কুল-কলেজে চাকরি করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। মুক্তবুদ্ধির চিরসজাগ প্রহরী আবুল ফজল জাতির সংকট মুহূর্তে নির্ভীক ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য ভূষিত হয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার, রাষ্ট্রিয় সাহিত্য পুরস্কার ও সমকাল পুরস্কারে । ১৯৭৫-এ পেয়েছেন সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি । ১৯৮৩, ৪ মে, রাত ১১টা ১৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।