"বড়দের শৈশব" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: বড়দের জীবন ও অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য পথের দিশা। তাদের জ্ঞানসাধানা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং কর্মকথা ও গল্পমালায় আমাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত প্রেরণা। জীবনীগ্রন্থগুলো সেসব চেষ্টা-প্রচেষ্টা, সংগ্রাম-সাধনা, কর্মপ্রয়াস ও সফলতার গল্প এবং অজস্র স্মৃতিকথায় পূর্ণ। কিন্তু ছোট বয়সের ও ছাত্রজীবনের সেই রঙিন-কোমল দিনগুলোর বিবরণ তেমন একটা পাওয়া যায় না, যখন তারা ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে, মানুষের কাছে অচেনা, অজানা, অপরিচিতরূপে। আর জানা হয় না, কেমন ছিল সেই ভুবনমোহিনী পুষ্পের বেড়ে ওঠা, যার সৌরভে গোটা বিশ্ব আজ বিমোহিত, যার সাধনার আলো ও হৃদয়ের উত্তাপ ছড়িয়ে রয়েছে মহাকালজুড়ে, যিনি আছেন যুগযুগান্তে নবীনদের আদর্শ হয়ে। অনুবাদগ্রন্থ ‘বড়দের শৈশব’ লব্ধপ্রতিষ্ঠিত উর্দু সাহিত্যিক ও খ্যাতিমান বক্তা মাওলানা মুহাম্মদ আসলাম শেখোপুরীর এক অনন্য সৃষ্টি। এতে উঠে এসেছে উপমহাদেশের ২৬ জন বিখ্যাত মনীষীর শৈশবকথা ও জীবনের প্রাথমিক দিনগুলো, যারা পরবর্তী সময়ে মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ইমামুল আসর, মুফাক্কিরে ইসলাম প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন এবং উম্মতের খেদমতে ও মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত থেকেছেন। আমরা আশা করি, অসাধারণ এই বইটি তালিবুল ইলমদের জন্য পরশপাথরের ভূমিকা পালন করবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্দেশ্য নির্ধারণে সহায়ক হবে; সঙ্গে সঙ্গে সেসব বিষয় জানা এবং অবলম্বন করার ক্ষেত্রেও সাহায্যকারী হবে, যেগুলোর বরকতে তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
মাওলানা মুহাম্মদ আসলাম শেখোপুরী রহিমাহুল্লাহ। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের অন্তর্গত শেখোপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার সম্মানিত পিতার নাম মুহাম্মদ হুসাইন। বংশগতভাবে তারা ছিলেন জমিদার। মাওলানা শেখোপুরী রহ. যখন মাত্র তিন বছরের শিশু, তখন পক্ষাঘাতের শিকার হন। সেই থেকে তিনি সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান এবং হুইলচেয়ারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। শিশুকাল থেকেই তার মধ্যে পড়াশোনার অদম্য স্পৃহা লক্ষ করা গেছে। প্রতিমুহূর্তে তিনি পড়ার জন্য অস্থির থাকতেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে তুখোর মেধা ও স্মৃতিশক্তি দান করেছিলেন। তিনি একবার যা পাঠ করতেন, তা তার স্মৃতির অংশ হয়ে যেত। মাওলানা শেখোপুরীর বয়স যখন ৯ বছর এবং যখন তিনি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়েন, তখন গ্রামের ইমাম সাহেবের পরামর্শে বাবা তাকে হিফজ পড়ানোর জন্য সম্মত হন। মাত্র ১১ মাসে তিনি পূর্ণ কোরআন মুখস্থ করে গ্রামবাসী ও আত্মীয়স্বজনকে অবাক করে দেন । নিজ গ্রামেই দরসে নেজামির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর তিনি মাওলানা সারফারাজ খান সফদার রহ. এর জামিয়া নুসরাতুল উলুমে ভর্তি হন। সেখান থেকে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া করাচিতে চলে যান। সেখানে তিনি মাওলানা ইউসুফ বানুরি, মাওলানা ওয়ালি হাসান টুঙ্কি, মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ লুধিয়ানবির মতো বিশ্বখ্যাত মনীষী আলেমদের সান্নিধ্য লাভ করেন । জামিয়া বানুরিয়া আল-আলামিয়্যায় মাওলানা শেখোপুরী দীনী ইলম শিক্ষাদানের মহান খেদমতে ব্ৰতী হন। জামিয়া বানুরিয়ার পর তিনি জামিয়াতুর রশিদ আহসানাবাদে তাফসির ও হাদিসের উসতাদ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। সাত বছর এই প্রতিষ্ঠানে তার দীনী খেদমত আনজাম দেওয়ার সুযোগ হয় ৷ আল্লাহ তায়ালা মাওলানাকে অধ্যয়নের রুচিবোধ দান করেছিলেন। পাশাপাশি তাকে দিয়েছিলেন পাঠদানের যোগ্যতা এবং মানুষকে বোঝানোর এক আশ্চর্য ক্ষমতা । তার আলোচনা হতো অত্যন্ত চমৎকার ও হৃদয়গ্রাহী। অল্পসময়ের ব্যবধানেই মানুষের মধ্যে তার আলোচনার ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৩ সাল থেকে তিনি কোরআনের দরস দিতে শুরু করেন । অল্প সময়ের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা তার কোরআনের দরসগুলোর এত অধিক গ্রহণযোগ্যতা দান করেন যে, পৃথিবীব্যাপী অসংখ্য মানুষ তার দরস শোনার অপেক্ষায় থাকত। তিনি সেই আলোচনা বিশ পারা পর্যন্ত সম্পন্ন করে যেতে পেরেছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে প্রদত্ত তার কোরআন ও হাদিসের দরসের সংখ্যা ২০০০ থেকেও অধিক । মাওলানার লেখালেখি সম্পর্কে যথার্থই বলা যায় যে, তিনি ছিলেন উরদু ভাষার একজন রুচিবান ও গতিশীল সাহিত্যিক আলেম । তার লেখায় অন্যরকম এক প্রভাব ও আকর্ষণ ছিল। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই ডজনেরও বেশি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- তাফসিরে তাসহিলুল বয়ান (অসমাপ্ত), উশাকে কোরআন কে ঈমান আফরোজ ওয়াকেয়াত, বড়ো কা বাচপান, তাফহিমাতে রসে সহিহ মুসলিম, খোলাসাতুল কোরআন ও আহসানুল কাসাস । মাওলানার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল তাফসিরে তাসহিলুল বয়ান নিয়ে; কিন্তু তা তিনি পূর্ণ করে যেতে পারেননি। চারটি খণ্ড পূর্ণ হয়েছিল এবং পঞ্চম খণ্ডের কাজ প্রায় শেষপর্যায়ে ছিল; এমন অবস্থাতেই দুনিয়াকে তিনি আলবিদা জানান । ‘কোরআনের দরস’কে দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি দরসেকোরআনডটকম নামে একটি ওয়েবসাইট চালু করেছিলেন। ১৩ মে ২০১২ তারিখে দরসে কোরআন অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে পাকিস্তানের করাচি শহরে আততায়ীর গুলিতে তিনি শহিদ হন। তার জানাজা পড়িয়েছেন মুফতি তাকি উসমানি হাফিজাহুল্লাহ। জানাজাপূর্ব সংক্ষিপ্ত ভাষণে লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে তিনি বলেছিলেন, “মাওলানা আসলাম শেখোপুরীর জন্য এ বড় সৌভাগ্যের বিষয় যে, সারা জীবন তিনি কোরআন ও হাদিসের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। অবশেষে কোরআনের দরস থেকে ফেরার পথেই শহিদ হলেন' । অন্যত্র তিনি বলেন, ‘চলৎশক্তিহীন মাওলানা শেখোপুরী মানুষকে কোরআনের প্রতি আহ্বান জানাতেন। তাকে এজন্যই শহিদ করা হয়েছে যে, কোরআনের প্রকৃত বার্তার সাথে তিনি মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিতেন'। মহান আল্লাহর দরবারে আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, তিনি যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসে স্থান দান করেন। আমিন।