”ছবি তোলা বাঙালির ফোটোগ্রাফি-চর্চা” বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: সেই এক সময়। রাধাবাজারের কোণে দাড়িয়ে শীর্ণকায় পকেশ বৃদ্ধ, হাতে ছােট একটি গ্লাস পজিটিভ, সমানে ‘ফোটোগ্রাফ’ ‘ফোটোগ্রাফ’ বলে চেঁচিয়ে যাচ্ছেন, আর পাড়াগেঁয়ে মানুষ দেখলেই প্রশ্ন করছেন, “মশাই, চেহারা উঠাইবেন? চারি আনা দিলেই চমৎকার চেহারা হইবে।” সেই এক সময় থিয়েটারের মতাে নক্সাকাটা একরঙা সিনের সামনে ফাঁসির আসামীর মতাে দম আটকে বসে আছে উৎসুক গ্রাহক। তেঠেঙার উপরে কাঠের তৈরি অতিকায় প্লেট-ক্যামেরা চড়িয়ে কালাে ঘােমটায় মুখ ঢেকে ঘষা কাচের উপরে ফোকাস তুলে নিচ্ছেন ফোটোগ্রাফার। লেন্সের ক্যাপটা হাতে খুলে নিয়ে আওড়াচ্ছেন, “ঐ পাখি উড়ে গেল উড়ে গেল...” বা “ওয়ান, টোয়াইস, থ্রাইস।” আর সেই সঙ্গেই বিচিত্র ভঙ্গিতে হাত ঢুকিয়ে আবার ঢেকে দিচ্ছেন লেন্স। সেই এক সময় টাউন হলে বক্তৃতা সেরে গােপনে ঘােড়ার গাড়ি চেপে পালিয়ে যাচ্ছেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র। প্রাণ বাঁচল, কিন্তু ইংরেজদের চক্রান্তে খােয়াতে হল ফোটোগ্রাফিক সােসাইটি অব বেঙ্গলের প্রথম অবৈতনিক কোষাধ্যক্ষের পদ। সিদ্ধার্থ ঘােষের এই দারুণ কৌতুহলকর ও তথ্যবহুল বইতে বাঙালির ফোটোগ্রাফি-চর্চার সেই সময়কেই অবিকল ফিরিয়ে আনার এক মহৎ চেষ্টা। ঊনবিংশ শতাব্দীর এমনতর আরও নানা দৃশ্য ও ঘটনার। নেপথ্যকাহিনী, হিন্দুদের অন্দরমহলে, এমনকি ঠাকুরঘরেও, ম্লেচ্ছদের আনা ফোটোগ্রাফের ছাড়পত্রলাভের অজানা বৃত্তান্ত, ঈশ্বর গুপ্ত, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রামকৃষ্ণ বা রবীন্দ্রনাথের বহু-পরিচিত ফোটোগ্রাফের। অপরিচিত স্রষ্টাদের ইতিহাস গল্পের মতাে করে এ বইতে শুনিয়েছেন তিনি। শুনিয়েছেন, ঠাকুরবাড়ির জ্ঞানদানন্দিনী দেবী থেকে বিবি রােজিও লেনের চঞ্চলাবালা দাসী, মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য থেকে আর্যকুমার চৌধুরী, নীলমাধব দে থেকে শরৎচন্দ্র সেন, উপেন্দ্রকিশাের থেকে সুকুমার কি যামিনী রায় চেনা-অচেনা এমন বহু ব্যক্তিত্বের কথা, বিবিধ পেশার, বিবিধ বিত্তের শতাধিক বাঙালির ও বাঙালি সংস্থার ফোটোগ্রাফি-চর্চার আনুপূর্বিক, অজ্ঞাত ও রােমাঞ্চকর ইতিহাস। পাশাপাশি এঁকেছেন ভারতে ইউরােপীয়ান ফোটোগ্রাফারদের অতিরঞ্জিত কৃতিত্ব-গাথার এক বিরুদ্ধ-চিত্র। রঙিন ও সাদাকালাে ছবির দুর্লভ, বিশাল এক সংগ্রহ- যার অধিকাংশই আর্টপ্লেটে ছাপা এ গ্রন্থের আকর্ষণ বহুগুণ বাড়িয়েছে।