ভূমিকা শ্রীগৌরাঙ্গ দেবের অন্ত্যলীলা শ্রবণের অত্যধিক আগ্রহেই শ্রীবৃন্দাবনের বৈষ্ণবমণ্ডলী শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীকে শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত-রচনার জন্য অনুরোধ করিয়াছিলেন। কবিরাজ গোস্বামীর যোগ্যতা সম্বন্ধে কাহারও সন্দেহ ছিল না। সুতরাং তাঁহার রচনায় বৈষ্ণবগণের আকুল আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত হইয়াছিল। কিন্তু এই গুরুদায়িত্ব পালন করিতে গিয়া কবিরাজ গোস্বামী এক সুকঠিন সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছিলেন। শ্রীচৈতন্য-ভাগবতের উত্তর-চরিতরূপে তাহার সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া তিনি শ্রীমন্মহাপ্রভুর যে অভিনব আলেখ্য অঙ্কিত করিয়াছিলেন, দেশ-কালের অতিক্রান্ত মহিয৷ তাহার দিব্য-দ্যুতিকে অবিনশ্বর সৌন্দর্য-মণ্ডিত করিয়াছে। শ্রীরায়রামানন্দ, শ্রী- বাসুদেব সাৰ্ব্বভৌম, শ্রীস্বরূপ দামোদর, শ্রীরূপ গোস্বামী প্রভৃতি ঋষিগণ শ্রীমহাপ্রভুকে নূতন দৃষ্টিভঙ্গী লইয়াই দেখিয়াছিলেন। পুরীধামের এবং বৃন্দাবনের আচার্য্যগণের সেই দৃষ্টিলব্ধ অপরোক্ষানুভূতি সংস্কৃত কবিতাতেই নিবদ্ধ ছিল। শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজই সেই শ্লোকাবলী বিশ্লেষণ পূর্ব্বক সে সকলের তথ্য ও তত্ত্ব সমুহ বাঙ্গালা কাব্যে সুশৃঙ্খল ভাবে অতি নিপুণতার সহিত সন্নিবেশিত করিয়াছেন। কবিরাজ গোস্বামীর এই দিব অবদান চিরস্মরণীয়। শ্রীমন্মহাপ্রভুর অবতার-রহস্য শ্রীপাদ নিত্যানন্দের অজ্ঞাত ছিল না। আর শ্রীনিত্যানন্দের আদেশেই শ্রীল বৃন্দাবন দাস ঠাকুর শ্রীচৈতন্যমঙ্গল (পরে শ্রীচৈতন্যভাগবত নামে অভিহিত ) গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় শ্রীবৃন্দাবন দাস যুগ-প্রয়োজন শ্রীনামসংকীৰ্ত্তন-প্রবর্তন ভিন্ন শ্রীমহাপ্রভুর অবতরণের অপর কোন কারণ প্রকাশ করেন নাই । সেকালে শ্রীবৃন্দাবন বিশেষতঃ প্রীধামের সঙ্গে বাঙ্গালার নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ অব্যাহত ছিল। যতদিন শ্রীমহাপ্রভু মরধামে বর্তমান ছিলেন, প্রতি বৎসর বাঙ্গালা হইতে প্রায় দুইশতাধিক ভক্ত পুরীধামে গিয়া কয়েক মাস অবস্থিতি করিয়া আসিতেন। ইঁহাদের মধ্যে মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ ভক্তের সংখ্যা বড় কম ছিল না। পুরীধামে ঋষি-দৃষ্টিতে শ্রীমহাপ্রভুর যে সমস্ত তত্ত্ব উদ্ঘাটিত হইয়াছিল, ইহারা তাহার সমগ্র রহস্যই অবগত ছিলেন এবং একথা নিশ্চিত যে, এই সমস্ত তত্ত্ব বাঙ্গালায় বহুলরূপে প্রচারিত হইয়াছিল। অনুমান করিতে পারি শ্রীল বৃন্দাবন দাসেরও তাহা অজ্ঞাত ছিল না ৷ কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্য্যের বিষয়, শ্রীচৈতন্যভাগবতে সেই সমস্ত রহস্যের প্রসঙ্গমাত্র উল্লিখিত হয় নাই । এই অনুল্লেখ আজ পর্য্যন্ত কাহারো দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাই । আমরাও এখানে ইহার ইঙ্গিতমাত্র করিয়া রাখিলাম । সময়াত্তরে কোন পৃথক্ প্রবন্ধে এই সমস্যার আলোচনার ইচ্ছা রহিল ।