"নৈঃসঙ্গের গোলকধাঁধা" বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে নেওয়া বিস্ময়কর এক নগর ভূতগাছাকে পটভূমে রেখে নৈঃসঙ্গের গােলকধাঁধা নামের যে উপন্যাসটি রচনা করেছেন ঔপন্যাসিক সাইদ হাসান দারা, ঘটনা, চরিত্র ও নির্মাণ প্রকৌশলে তা হয়ে ওঠে উলম্ফিত, রহস্যময় ও ঘােরগ্রস্ত সময়ের এক আখ্যান। কাহিনির সংবন্ধনে এমন এক জাদুময় জগৎ উঠে আসে, সহসা ঠাহর করা যায় না কোন সময়ের গল্প এটি; এটিকে কখনাে অতীতকালের প্রাগৈতিহাসিক যুগের আবার কখনাে অনাগত ভবিষ্যকালের গল্প বলে ভ্রম হয়; ভ্রমই হয়, কেননা প্রধানত ভূতগাছা নগরের অধিবাসীদের জীবন-যাপন, শিক্ষা, সাহিত্য, রাজনীতি ও অন্ধকারে চুপিসারে বেড়ে ওঠা পােকামাকড় আমাদের জানিয়ে দেয় সময়টা আসলে বর্তমানের; যে সময়ে মানুষ ও পশু স্বভাবে ও সভ্যতায় একাকার হয়ে থাকে। যদিও পশু কখনাে মানুষের ভব্যতা অনুশীলন করতে পারে, মানুষ তা পারে না; বরং মানুষের অন্তর্গত অন্ধকার বাইরে প্রকাশিত হয়ে পড়ে বলে ভূতগাছা নগর জুড়ে রাত নেমে আসে; অথবা রাত নেমে আসার কথাটি ভুল, হয়ত তথাকথিত ভূতগাছা নগরে কখনাে দিন হয় না। এরকম পরিপ্লুত অন্ধকারে ইকতিয়ার খলিল নামের প্রাণীটিও যখন বৈজ্ঞানিক আগ্রহের সঙ্গে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখতে থাকে ধ্বংসপ্রায় বাড়িগুলাের বাইরেটা, মরিচার আগ্রাসনে জর্জরিত জানালার শিকগুলাে, আর গ্রিল, আর সামান্য জায়গায় কেমন নিবিড়ভাবে গজিয়ে উঠেছে বিস্তর আগাছা, যার ভারে ক্রমেই যেন নুয়ে পড়ছে সমগ্র শহরটা।’-তখন নগরের সামূহিক আগাছা-বিস্তৃতি নিশ্চিত করেই ভাবনার গভীরে নিয়ে যায়। বস্তুত, নৈঃসঙ্গের উপত্যকা আখ্যানে যে সমস্ত চরিত্র, যারা প্রকৃতস্বভাবে একেকটা আগাছা-পরগাছা, পারস্পরিক সম্পর্কে সম্পৃক্ত হয়, তাদের মােহ, কামনা ও রিরংসার মধ্যে আমরা অবাক হয়ে আমাদেরকেই দেখতে পাই; তখন, তুমুল মাহমুদ, আব্দুর রহমান, বকতিয়ার খলিল, এলিসা বেগম, মিস ডােনা কিংবা ব্রাত্য আলেয়াকেও অচেনা মনে হয় না। তবে সুড়ঙ্গের শেষপ্রান্তের আলােটুকুর মতােই যাবতীয় আদিমতা সত্বেও মানুষের মধ্যে যেটুকু মনুষ্যত্ব শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে তার জন্যেই হয়ত ইকতিয়ার খলিল অনবচ্ছিন্নভাবে পনেরাে বছর ধরে আত্মগ্লানিতে জর্জরিত হয় যতদিন পর্যন্ত অসমবয়সী পরিচারিকার গর্ভে তার ঔরসজাত সন্তান টেংকু একটা দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ না করে। তবে, টেংকুর মৃত্যু ইকতিয়ার খলিলকে মানবিক সত্তায় উদ্বোধিত করবে কি না- উপন্যাস পাঠ শেষেও এই প্রত্যয়টুকু আমাদের দ্বিধান্বিত রাখে। ‘নৈঃসঙ্গের গােলকধাঁধা’ নামের মধ্যেও যেমন অন্তর্লীন হয়ে আছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাস তেমনি ভূতগাছা নগরের মানচিত্রেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিই প্রতিস্থাপিত হয়। অর্থগৃধ্নুতা, কাম ও রিরংসার ইন্দ্রজালে আচ্ছন্ন এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে সাইদ হাসান দারা-র মধ্যেও আমরা পেয়ে যাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নুতন প্রজন্মের অগ্রসর চিন্তার একজন ঔপন্যাসিককে।
মুক্তিযুদ্ধের লেখক-গবেষক হিসাবে সুপরিচিত ঔপন্যাসিক সাইদ হাসান দারা-কে একজন। বহুমাত্রিক লেখক হিসাবে আখ্যায়িত করলে খুব একটা ভুল হবে না। তিনি বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচনা করেছেন অসংখ্য নজরকাড়া আলােচিত উপন্যাস-আখ্যানউপাখ্যান এবং গবেষণাধর্মী গ্রন্থ। পাশাপাশি তিনি ৯০ দশকের পুরােটা সময় জুড়ে দেশ-বিদেশের প্রচারবহুল জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক পত্রিকাসহ দেশ বিদেশের অগণিত লিটিল ম্যাগাজিনে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নানাবিধ প্রবন্ধও লিখেছেন। এবং স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন একজন। ব্যতিক্রমী চিন্তার লেখক-ঔপন্যাসিক হিসেবে। তিনি সর্বদাই একজন নিভৃতচারী লেখক; নিবিড় পরিচর্যায় মননী। গড়ে উঠেছেন নিজস্ব চিন্তায় এবং সর্বদা শিক্ষা নিয়েছেন প্রকৃতির পাঠশালা থেকে। সৃজনশীলতা ও মননশীলতা তার অস্থিমজ্জায়-ইত্যকার প্রমাণ মিলবে তার সকল গ্রন্থে। তিনি ১৯৬৩ সালের ১০ আগস্ট পাবনা শহরের উপকণ্ঠে ছাতিয়ানী গ্রামের এক। সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।