পড়লাম ফেরদৌস হাসানের "বন বালিকার গান"। ঢাকা শহরের কর্পোরেট অফিস থেকে গল্প শুরু হয়ে শেষ হয়েছে গিয়ে প্রত্যন্ত এক অজ পাড়া গাঁয়ে। শহরের ঝাঁ চকচকে আলো আর পোশাকের আড়ালে মানুষের অসহায়ত্ব, লোভ, লোভের পরিণাম এসব যেমন এসেছে; তেমন ফুটে উঠেছে এসবের সাথে মানিয়ে নিতে না পেরে পালিয়ে বাঁচতে চাওয়া মানুষের আর্তনাদ। হাজার প্রলোভন ও সুযোগের হাতছানি এড়িয়ে কেউ কেউ খুঁজতে চেয়েছে মানুষ। কারা সেই মানুষ? নির্ঝঞ্ঝাটে সংসার করা সামাজিক মানুষ নাকি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ঈশ্বরসন্ধানী কেউ? বাউল বা লোকধর্মচারী সম্প্রদায়ের জীবনদর্শন লেখক দুটি চরিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, যা পাঠককে ভাবাবে। প্রেম এখানে হাতছানি দিয়েছে দু'টি বিপরীত মেরু থেকে। একদিকে চাঁদের পাহাড়, অন্যদিকে নিঃস্ব হওয়ার ঝুঁকি। চরিত্র সংখ্যা হাতে গোণা। তার ভেতরেও পাঠক নিজের একটি চরিত্র খুঁজে পাবেন। এ কোনো রূপকথা নয়। আমাদের জীবন যাপন ও আকাঙ্ক্ষার একটি মলাটবদ্ধ সংস্করণ। লেখক তাঁর পাখির দৃষ্টি দিয়ে দেখে শুধু আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। সমসাময়িক বাস্তবতার অনেক প্রশ্নের উত্তর হয়তো এই উপন্যাসে আছে। চিন্তাশীল পাঠকের মনের খোরাক জোগানোর মতো একটা গল্প, এটুকু বলা যায়।
বাংলাদেশের নাট্যজগতে ফেরদৌস হাসান এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাম। নাট্যকার হওয়ার কারণে তাঁর লেখা কাহিনীতে থাকে ব্যাপক মােচড়। তাঁর উপন্যাস পড়লে ঢুকে যেতে হয় মায়াবী ইন্দ্রজালে। ফেরদৌস হাসান তৈরি করেছেন এক নিজস্ব গল্প বলার ঢঙ। তার লেখা উপন্যাস বা তার তৈরি নাটক দেখলে অনায়াসেই বুঝে ফেলা যায়, এই নাট্যকার বা ঔপন্যাসিকের নাম। বানিয়েছেন পাঁচ হাজারেরও বেশী নাটক। লিখেছেন প্রায় অর্ধশত গল্প, উপন্যাস। নাটকশীতের পাখি, সেই এক গায়েন, ঝুমকা, তেমনি আছি, আমি শিমুলের কাছে, আমার কেবলই রাত হয়ে যায়, একটি নীল জামা, ঝরা পাতাটুকু, নক্ষত্র দিনের গল্প, সাদাকালাে তাঁরই অমর সৃষ্টি। ধারাবাহিক নাটকগুলাের মধ্যে কয়েকটি হল ফেরা, শ্যওলা, সম্পূর্ণ রঙিন, মহানগর, প্রজাপতি দিন, প্রতিদিন একটি গােলাপ, অন্ধকারের ফুল, বন্ধু আমার, মায়া। ইত্যাদি অবিস্মরণীয় । জনপ্রিয় উপন্যাসগুলাের মধ্যে রয়েছে। তােমার বসন্ত দিনে, আমার কেবলই রাত হয়ে যায়, এখানে তােমার আকাশ, বুকের কাছে জল, মায়া, ভালবাসি, সে আমার একলা পাখি, সে অসীমা বলে পাইনি, ঝরা পাতা টুকু। আশির দশক থেকে লিখে আসা তাঁর রচনায় সমসাময়িক বিষয় উঠে আসে চমৎকার নৈপূণ্যতায় । ব্যক্তিজীবনে খুবই সহজসরল জীবনযাপন করেন ফেরদৌস হাসান । বিশ্বাস রাখেন স্রষ্টায় আর খুঁজে বেড়ান তাঁর সান্নিধ্য।