"জাপানের উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ জাপানের অভাবনীয় সাফল্য ও বিস্ময়কর অগ্রগতি—গত শতাব্দী জুড়েই ছিল বিশ্ব অর্থনীতির একটি আলােচিত বিষয়। কীভাবে দেশটি এত প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতার মাঝেও এই অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হলাে সেটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। তা নিয়ে নানা ধরনের মতামত পাওয়া গেলেও এ কথা সবাই স্বীকার করেছে যে, জাপানের উন্নয়নে দক্ষ মানবসম্পদই ছিল প্রধান চালিকাশক্তি। উন্নয়ন অর্থনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দর্শন ও বিষয় ‘মানবপুঁজির’ তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদহীন জাপান তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন শতভাগ নিশ্চিত করেছে। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে জাপান সরকারের সুদূরপ্রসারী নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে জাপানে গুরুত্বপূর্ণ ও দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যায়। মেইজি’র পুনরুত্থানের অল্প সময়ের মধ্যেই ১৮৭২ সালে মৌলিক শিক্ষা আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে ঘােষণা করা হয় যে, কোনাে পরিবারে কোনাে নিরক্ষর সদস্য থাকবে না এবং সমাজে কোনাে নিরক্ষর পরিবার থাকবে না। সুতরাং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই শিক্ষার এই ঘাটতি পূরণ করে জাপান অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টি করে। ১৯১০ সালের মধ্যে প্রায় সবাই শিক্ষিত হয়ে যায় অন্তত সকল তরুণেরা বিদ্যালয়মুখী হয়েছিল। শিক্ষার উন্নয়নে তারা কতটা অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিল তা একটি উদাহরণ থেকে ধারণা পাওয়া যাবে: ১৯১৩ সালের মধ্যে জাপান থেকে প্রকাশিত বইয়ের পরিমাণ ছিল ব্রিটেনের অধিক এবং আমেরিকার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণেরও অধিক বই প্রকাশিত হতাে যদিও সেই সময় জাপানের অর্থনীতি ছিল ব্রিটেন-আমেরিকার চেয়ে অনেক দুর্বল। বৃহত্তর অর্থে শিক্ষার মূল গতিপ্রকৃতি ও উদ্দেশ্যই ছিল জাপানের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করা (অমর্ত্য সেন: ২০০৩)। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলােচনার ক্ষেত্রে শিক্ষা উন্নয়নের ঐতিহাসিক ধারাকে বিভিন্ন পর্বে আলােচনা করা যায়। কিন্তু পাঠের সুবিধার্থে আমি এখানে জাপানের শিক্ষা উন্নয়নের ইতিহাসকে চারটি পর্বে বিভক্ত করে আলােচনা করতে চেষ্টা করেছি। প্রথমত শিক্ষার সনাতন ধারা (৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দ অবধি), দ্বিতীয়ত এদো যুগের শিক্ষাব্যবস্থা (১৬০৩-১৮৬৮), (এদো যুগকে ‘তােকুগাওয়া যুগ'ও বলা হয়। একই সঙ্গে একে বলা হয় বিচ্ছিন্নতার কাল৬), তৃতীয়ত মেইজি যুগ ও তৎপরবর্তীকালের শিক্ষা (১৮৬৮-১৯৪৫), এবং চতুর্থত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আধুনিক জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা।