মানুষটিকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। তিনি প্রদীপ্ত সূর্যের মতোই স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাদের অন্যতম। তিনি অনলবর্ষী বক্তা। যার মুখনিসৃত বক্তৃতায় দেশপ্রেম আর বিদ্রোহী চেতনায় উদ্ভাসিত হয় মুক্তিকামী মানুষের মিছিল। যিনি অন্ধকারে ছেঁয়ে যাওয়া গণতন্ত্রকে মুক্তি দিতে জীবন বাজি রেখে লড়ে চলেছেন। শুধু কথায় নয় তার ক্ষুরধার লেখনি গণতন্ত্র মুক্তির বীজ রোপণ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। গণতন্ত্র যখন দেশে নিয়ন্ত্রিত, মুক্ত গণমাধ্যম যেখানে খাঁচায় বন্দি, রাজনীতি আছে কি নেই এ যখন ভাবনার বিষয়, রাজনৈতিক বার্তাবরণ যেখানে শুধুই বিবৃতি আর শোক প্রকাশের মধ্যেই সীমিত। সেখানে তিনি একাই তার অবস্থানে অটুট থেকে লড়ে চলেছেন, কথা বলে যাচ্ছেন, লিখছেন। সকল বাধা বিপত্তিকে তোয়াক্তা না করে পথ চলেছেন। যে মানুষটির কথা বলছি তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রণী সৈনিক। একাত্তরে ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে গঠিত স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রিয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নূরে আলম সিদ্দিকী। যিনি বঙ্গবন্ধুর চার খলিফার অন্যতম। অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ নূরে আলম সিদ্দিকী এবারের বই মেলাতে হাজির হচ্ছেন; সরবে স”কিত উচ্চারণে। গত দু বছরের মতো সময়োচিত সত্যভাষণ নিয়ে; তার লেখনি নিয়ে উদ্ভাসিত করবেন রাজনৈতিক বীক্ষায়। ‘কালের কলধ্বনি’ বইটিতে নূরে আলম সিদ্দিকীর বিশের অধিক লেখায় স্পষ্ট হয়েছে চলমান সময়। আশা করি, পাঠক এই লেখার মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক গতি প্রকৃতি সম্পর্কে যৎকিঞ্চিত হলেও ধারণা পাবেন।
তিনি বিগত শতাব্দীর ষাট দশকের এক অনবদ্য সংগ্রামী পুরুষ। ঐ দশকের অগ্নিঝরা দিনগুলিতে ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী তুর্কি তাজির মতো ক্ষুরের দাপটে মেদিনী কাঁপিয়েছেন। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাকের কালজয়ী সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের স্নেহাস্পর্শে গণতন্ত্র, অসম্প্রদায়িকতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক চেতনায় বেড়ে উঠেছেন তিনি। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক মতাদর্শ তাঁর রাজনৈতিক জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। ছয় দফা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মনু মিয়ার রক্তাক্ত জামা নিয়ে ’৬৬-এর ৭ জুন ঢাকায় আইউববিরোধী মিছিলের নেতৃত্বদানের মধ্য দিয়ে এ দেশের রাজনীতিতে একজন বলিষ্ঠ ও সুযোগ্য ছাত্রনেতা হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৭০-এর নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের তদানীন্তন সভাপতি হিসেবে তিনি যে সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রেখেছেন, তা এদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বলতম অধ্যায় হয়ে রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৭১-এর ১ মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার মুহূর্ত থেকে স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তরকালে স্বাধীনবাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সব সভায় সভাপতিত্ব করার একক গৌরব তাঁর। ২৩ মার্চ ১৯৭১-এ প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলনের সময় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃ চতুষ্টয় আনুষ্ঠানিক অভিবাদন গ্রহণ করার পর সেই পতাকাটি তিনি সগৌরবে বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন। তিনি আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে আজও তিনি বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ-ত্যাগ এবং নেতৃত্বের বিশ্বস্ত অনুসারী হিসেবে নিজেকে অবিচল অবস্থানে ধরে রেখেছেন। দেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আজ যে কক্ষচ্যুতি, পথভ্রষ্টতা, স্বার্থমগ্নতা এবং নিজ হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার দূষিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, নূরে আলম সিদ্দিকী তাতে বিচলিতবোধ করেন। বৃহত্তর যশোরের ঝিনাইদহে ১৯৪৪-এর ২৬ মে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নূরনবী সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মানিক মিয়ার ঘনিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন। ১৯৬৬-এর জুনে ছয় দফার পক্ষে আয়োজিত হরতালে বলিষ্ঠ নেতৃত্বদানের অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হন। অতঃপর ১৭ মাস কারান্তরালে থাকাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন এবং ঐ বন্দিদশায়ই তিনি স্নেহময়ী জননী নূরুন নাহার সিদ্দিকীকে হারান। কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে থাকা অবস্থায় তিনি বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসশাস্ত্রে ট্রিপল এমএ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৭০ সালে আইনশাস্ত্রেও উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের পর সামরিক বাহিনীর হাতে বন্দি অবস্থায় নির্যাতন, লাঞ্ছনা ও শত অপমানে জর্জরিত হয়েছেন; প্রতিনিয়ত মৃত্যুর প্রহর গুনতে হয়েছে তাঁকে। বর্তমানে তিনি ডরিন গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি সাবেক সাংসদ এবং প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের আহ্বায়কও। প্রকাশিত গ্রন্থ ৫টি : ‘একাত্তরের অজানা কাহিনী: এক খলিফার বয়ান’, ‘আওয়ামী লীগ বিরোধী নই, তবুও সমালোচনা করি’, ‘কালের কলধ্বনি’, ‘সংঘাত সংশয় সাফল্য’ ও ‘ইতিহাস একদিন কথা বলবেই’।