মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সাহিত্যে আধুনিকতার প্রথম পরিস্ফুটন উন্মোচন ঘটল তাঁর প্রথম রচিত উপন্যাস ‘বিদারাত্রির কাব্য’ (১৯৩৫)। লেখক নিজে বইটি সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘এটি গল্পও নয়, উপন্যাসও নয়, রূপককাহিনি। রূপকের এ একটি নূতন রূপ”। ‘দিবারাত্রির কাব্য’-এ এ আধুনিকতার লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। তার অধিকাংশাই ‘প্রটাগনিস্ট’ চরিত্র হেরম্বের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। অবশ্য প্রসঙ্গত বলা চলে, সুরাসক্ত ও ধর্মচর্চার আড়ালে অস্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত মালতী ও তার স্বামী অনাথের মধ্যকার দাম্পত্য সম্পর্কের জটিলতা ও চূড়ান্ত মানস বিচ্ছিন্নতার মধ্যেও লেখকের আধুনিক জীবনদৃষ্টির লক্ষণ পরিষ্ফুট। হেরম্বের মননধর্মী জটিল আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মখ-ন প্রকাশই তার চরিত্রে আধুনিকতার আদলটিকে স্পষ্ট করেছে। হেরম্বর কোনো নিরাশ্রমী প্রেমে ইতিবাচক সাড়া দিতে অক্ষম। সেখানে সে ‘বরফের মতো শীতল’। তাই সে সুপ্রিয়ার কাছ থেকে কেবলই পালিয়ে যেতে চায়। আসলে সে এককালের এক নিঃসঙ্গ নিঃসমাজ বিচ্ছিন্ন এক বিপন্ন সত্তা। হেরম্বের একটি পারিবারিক জীবনপট ছিল, ছিল স্ত্রী ও কন্যা। স্ত্রী গলায় দড়ি দিয়েছে। তারজন্যে হেরম্বের কোনো বেদনাবোধ নেই। আর মেয়ে সম্পর্কে তার উক্তি : ‘একটা মেয়ে আছেÑ দু’বছরের। আছে বলছি এজন্য যে পনের দিন আগে ছিল দেখে এসেছি। এর মধ্যে মরে গিয়ে থাকলে নেই।’ সব মিলিয়ে জীবন সম্পর্কে এব প্রবল অর্থহীনতা, এক নিদারুণ শূন্যতা ও নিস্ফলতার বোধে আক্রান্ত উপন্যাসটির মুখ্য চরিত্র। স্বীয় জীবনের এই নিরর্থতা হেরম্বের চরিত্রকে শুধু আধুনিক লক্ষণে চিহ্নিত করেছে তাই নয়, চরিত্রটিকে আধুনিক উপন্যাসের ‘অ্যান্টিহিরো’ এর পর্যায়ভুক্ত করেছে।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।