বাস্তি দেশভাগ ও পাকিস্তানের ট্র্যাজিক ইতিহাসের উপর লেখা উর্দু সাহিত্যের ক্ল্যাসিক উপন্যাস। বাস্তি মানে বসবাসের জায়গা, লোকালয়, গ্রাম, শহর। এতে সাতান্নর সিপাহি বিপ্লব, সাতচল্লিশের দেশভাগ, পয়ষট্টির ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের বাঙালির সংগ্রাম তথা ভারতবর্ষের বসতির খণ্ডবিখণ্ডের ইতিহাস উঠে এসেছে এক অসামান্য শিল্পকুশলতায়।
দক্ষিণ এশিয়ার শক্তিমান কথাকার ইনতেজার হুসেইনের এই উপন্যাসের শুরু পৌরাণিক আখ্যান, অতিন্দ্রীয় গল্প, তরুণ-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিমের মধ্যকার মিলনের মধ্য দিয়ে। তারপর উপন্যাসের নায়ক জাকির আধুনিক বিশ্বে পা রাখেন। জমে ভিড়, গর্জে উঠে শ্লোগান, পুড়তে থাকে নগর। এরই মাঝে আসে প্রেম। পরিবারের সঙ্গে একই ঘরে থেকে কিংবা লাহোরের ক্যাফে শিরাজে বন্ধুদের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য ও রাজনীতি নিয়ে আড্ডা দিতে থাকা ইতিহাসের অধ্যাপক জাকির তবু একাকিত্বের রাজনীতিতে হেরে দেশে একাই পড়ে থাকেন। ইনতেজারের যাদুকরী গদ্যে পাঠক পান জাকিরের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্ধ, বিশ্লেষণ। এতে কখনো কখনো ব্যক্তি জীবনের যতি হলেও ইঙ্গিতময়তা ও প্রতীক সৃষ্টির কারণে পাঠক আরব্য উপন্যাসের শেহেরজাদের দেখা পান। ফলে উপন্যাস ফুরালেও গল্প ফুরায় না।
হিন্দি ভাষী ভারতীয় কবি ও সমালোচক অশোক বাজপেয়ি বলেন, ‘ইনতেজার হুসেইন স্রেফ পাকিস্তানের নয়, বরং ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ এশিয়ার সবচে’ বড় লেখকদের একজন। তার যে আধুনিকতা তা শেকড়স্পর্শী ও আপন ইতিহাস অনুসন্ধানী আধুনিকতা, বাইরে থেকে আনা কোনো ফেলো আধুনিকতা নয়। এটা বেশ বড় বিষয়। তার গল্পে, বিশেষ করে উপন্যাসে কেচ্ছা বলার যে ফর্ম তিনি ব্যবহার করেছেন তা বড় অদ্ভুত।’
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ইনতেজার হুসেইনকে মান্টোর পর আধুনিক উর্দু সাহিত্যের সবচে’ শক্তিশালী লেখক বলে আখ্যায়িত করেছে। দ্য হিন্দুর মতে, বাস্তি দেশভাগের উপর রচিত সম্ভবত শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের কৃতিবিদ্য অধ্যাপক ও সভাপতি ডক্টর ফিরদৌস আজীম পাণ্ডুলিপি পড়ে ফ্ল্যাপে লিখেছেন:
'অনুবাদ এমন একটি মাধ্যম যা নানা ভাষায় রচিত বিশ্বসাহিত্যকে হাজির করে পাঠকের নিজের ভাষায়। ইনতেজার হুসেইনের ‘বাস্তি’ উপন্যাসটির বিশেষত্ব হলো এটি আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয় আমাদেরই গল্পের সাথে, তবে ভিন্ন আঙ্গিকে। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাসটি একটি বিচ্ছেদের আখ্যান যেখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে উর্দুভাষী অভিবাসীদের স্থায়ীভাবে শেকড়চ্যুত হওয়ার বেদনা। শুধু তাই নয়, এই আখ্যানে উঠে এসেছে বাংলাদেশের জন্মগাঁথাও। আবার এটি একটি পরিবারের একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার গল্পও বটে।
এই উপন্যাসের বয়ানে উন্মোচিত হয় বাস্তবতার নানা তল; আকারে-ইঙ্গিতে এটি আমাদের নিয়ে যায় এক অদৃশ্যলোকে, তাই এই বয়ানকে চেতন-অবচেতনের দোদুল্যমানতায় জাদুবাস্তবতাধর্মী বর্ণনাভঙ্গির একটা নতুন ঢং হিসেবেও দেখা যায়।
উর্দু ভাষার আমেজ ও মেজাজকে অবিকৃত রেখে সেটিকে ঝরঝরে বাংলায় অনুবাদ করা ভীষণ কঠিন একটি কাজ। আর এই কঠিন কাজটাকেই শৈল্পিক কুশলতার সাথে সম্পন্ন করেছেন সালেহ ফুয়াদ, যিনি বাঙালি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন একজন মহান উপমহাদেশীয় লেখকের সাথে। অনুবাদককে অভিনন্দন!'