আমার পেশা জীবনের সাথে এই বইয়ের নামকরণের শতভাগ মিল আছে। আমি এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্ম জীবনে প্রবেশ করেছিলাম এবং এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কর্ম জীবনের সমাপ্তি টেনেছি। এদেশের অসংখ্য শিক্ষিত বেকার, ক্রমাগত শিক্ষা সমাপন করে পেশা জীবনে প্রবেশ করা ইয়ং জেনারেশন, কর্পোরেটে কর্মরত উচ্চাকাঙ্ক্ষী সহকর্মী ও অসংখ্য উদ্যোক্তার জন্য মূলত এই বইটি লেখা। এক্সিকিউটিভ বা এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর কোনোটাই হওয়ার যোগ্যতা আমার ছিল না। আমি ইংরেজি সাহিত্য ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ছাত্র। আমার অন্যতম পজিটিভ দিক হচ্ছে কোনো কাজ করতে যেয়ে বাধার সম্মুখীন হলেই আমার ভিতরে এক বল্গাহারা, অপ্রতিরোধ্য মানসিক ও শারীরিক শক্তির যুগলবন্দী শুরু হয়। শুরু হয় বাধা ডিঙানোর খেলা। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু জীবনের প্রথম চাকুরী ফাইজারের মতো আমেরিকান বহুজাতিক ঔষধ কোম্পানিতে নিতে যেয়ে আমাকে বিজ্ঞানের অনেক কিছু শুরু থেকে শিখতে হয়েছে। সন্ধ্যায় বই নিয়ে বসেছি আর সকালের সূর্য ওঠা দেখেছি জানালা দিয়ে। কঠিন জিদ নিয়ে ট্রেনিং করেছি যাতে শত শত প্রার্থীর মধ্যে একজনকে নিলেও যেন ফাইজার আমাকে নির্বাচিত করে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত চার জনের মধ্যে আমি ছিলাম একজন। আমাদের সময়টা ছিল ফার্মাসিউটিকাল-এর স্বর্ণযুগ। জ্ঞান নির্ভর ছিল সেই পেশা। যে যত পেশাগত জ্ঞানে উৎকর্ষ লাভ করতে পারবে সে তত শক্ত ভীত তৈরী করে উন্নতি লাভ করতে পারবে। আমার পরের চ্যালেঞ্জ ছিল অটোমোবাইল। রানার মোটরস-এ চাকরি নিয়ে দিল্লিতে গেলে ভলভো-আইশারের ইঞ্জিনিয়ার বলেছিলো "how come a pharma guy in Automobile..... !!" আমি মনে মনে বলেছিলাম দেখা হবে কিছুদিন পর। প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল আমি আমার টিম নিয়ে কিভাবে অটোমোবাইলে পরিবর্তনের ঢেউ এনেছিলাম। পরের চ্যালেঞ্জ ছিল Akij Food and Beverage এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে। আমার বিজ্ঞানের জ্ঞান ছিল না। আমার বাবা-চাচা-মামা-খালু-আইন-বাবা তথা কেউ ছিল না। ছিল আল্লাহর রহমত ও তাঁর দেওয়া দেয়া ১০০ মিলিয়ন নিউরন। বাবা মায়ের প্রাণখোলা দোয়া আর আমার সততা, শৃঙ্খলা, কঠোর পরিশ্রম, কখনো কখনো ক্ষেপাটে পরিশ্রম, পাহাড়ের মতো ধৈৰ্য, নিষ্ঠা আর একাগ্রতা। এই বইতে আমি বলতে চেয়েছি আমার কিছুই ছিল না কিন্তু বিশেষ কিছু গুণাবলির চর্চা আর ধৈর্যের সাথে কঠোর পরিশ্রম আমাকে এক্সিকিউটিভ থেকে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর পর্যন্তু নিয়ে গেছে। আপনি চেষ্টা করলে অবশ্যই আপনিও হয়তো আমার বয়সের আগেই লক্ষ্যে পৌঁছে যাবেন। সিনিয়রদের যথোপযুক্ত সন্মান দেখায়েছি। পীরের খানকার তাজিমের মতো সন্মান করেছি। তাঁদের আগে চেয়ার-এ বসিনি, তাঁদের সামনে আগে হাঁটিনি, তাঁদের আগে কথা বলিনি, কোনো প্রতিবাদ করিনি, সমালোচনা করিনি, নিজের কণ্ঠ-স্বর তাঁদের কণ্ঠ-স্বরের চেয়ে উচ্চগ্রামে তুলিনি। শুধু একটা কাজই করিনি তাহলো, হাত কচ্লাইনি, মোসাহেবি করিনি, তৈলচর্চা করিনি। কিছু অসুবিধা হয়েছে সাময়িক কিন্তু শেষ হাসি আমিই হেসেছি। আমি দীর্ঘাঙ্গী না। আমার মেরুদণ্ডের দৈর্ঘ্যও অনেক লম্বা না। কিন্তু জীবনে এই শক্ত মেরুদণ্ড কোথাও বাঁকা করিনি। জীবনে দুই জায়গায় শুধু মেরুদণ্ড বাঁকা করেছি: রুকু এবং সেজদায়। এবং করে যাবো ইনশাআল্লাহ। আমি বলতে চেয়েছি: প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকলেও তা গড়ে নেওয়া যায় যদি ভিতরে জ্বালা থাকে, অস্থিরতা থাকে অর্জন করার । বিজ্ঞানের কিছু কঠিন বিষয়ের ব্যাতিক্রম ছাড়া যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদির ক্ষেত্রে জীবনের শুরু থেকেই তৈরী হতে হয়। তবে যে কোনো বয়সেই ব্যাতিক্রম হওয়া যায় সাধনার মাধ্যমে। তিল তিল করে নিজেকে তৈরী করতে হয়, অসীম ধৈর্য্য নিয়ে লেগে থাকতে হয়। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মেরুদন্ড বাঁকা না করেও আত্মমর্যাদা, আত্মসম্মান ঠিক রেখেও পেশাজীবনের শীর্ষে ওঠা যায়। এসবের নিখুঁত বর্ণনা আছে এই বইতে। পেশাগত বিষয়ের পাশাপাশি আমি প্রতিদিনের পড়ার ও চর্চা করার বিষয়গুলোকে সাহিত্য , দর্শণ, ধর্ম, বিজ্ঞান, সংগীত, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ের প্রাসঙ্গিক অনুষঙ্গ এনে নিরস বিষয়কে সরস করার চেষ্টা করেছি। প্রতিটা মাসে এক একটা গুণাবলির বিস্তারিত আলোচনা আছে সারা বৎসরের দিনগুলোতে। প্রতিদিনের জন্য একটা একটা লেখা। পড়তে পড়তে ৩৬৫ দিন শেষ হয়ে যাবে। পরের বৎসরের জানুয়ারি থেকে আবার শুরু করবেন এবং বর্ণিত গুণাবলির আমলের পরিপূর্ণতা, পরিপক্কতা আনার চেষ্টা করবেন। ক্রমাগত পড়তে থাকবেন। দেখবেন আপনি ঠিকই একসময় আপনার লক্ষ্যে পৌঁছে যাবেন। সাথে সাথে তৈরী হবে অনেক নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের যা আজকের দিনে দুর্লভ হয়ে উঠছে এবং আমরা সামাজিক ভাবে ক্রমেই নিচে নামছি। এক কোথায় এই বইকে "প্রফেশনাল-ধর্মগ্রন্থ" বলা যেতে পারে। যে ভাষাতেই লেখা হউক না কেন এবং যে শব্দের চয়ন ও বিন্যাসে লেখা হউক না কেন জীবনের উন্নতির মূলসূত্র গুলো কম বেশি এগুলোই। আপনারদের জীবনের কল্যান কামনা করছি।
লেখক পরিচিতিঃ "মানবিক বিভাগের ছাত্র হয়ে মাল্টিন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল ফাইজারে চাকরি নেওয়া ছিল স্বপ্নাতীত। সন্ধ্যায় বই নিয়ে বসেছি আর সকালে জানালা দিয়ে সূর্য্য উঠা দেখেছি।" কঠিন বিষয় ও টার্মিনোলোজি রপ্ত করে পরদিন ট্রেনিংএ উপস্থিত হতে হয়েছে। প্রতিদিন ছিল ট্রেনিং থেকে বাদ পড়ার উৎকণ্ঠা। ধনুক ভাঙা পণ করে সাধনায় বসেছিলাম বুদ্ধদেবীয় সংকল্পে। আমার সোনার হরিণ চাই। চাকরি জীবনে প্রতিনিয়ত নিজেকে আপডেট রেখে ক্যারিয়ার-এ ন্যাশনাল সেলস মার্কেটিং টিমের দায়িত্ব নেওয়া ছিল প্রথম চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করা। নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে রানার মোটোর্স্ এ যোগদান। "How come a pharma guy in Automobiles Sales Marketing ?" আমার জয়েনিং-এর পর ফ্যাক্টরী ভিসিট-এ দিল্লী গেলে ভলভো-আইশার-এর ইঞ্জিনিয়ারের মন্তব্ব্যে আবার জিদে আগুণ লাগে চ্যালেঞ্জের দ্বিতীয় ধাপ অতিক্রম করার। রানার মোটরসের সাফল্যের ৭ বৎসর পর ডিরেক্টর মার্কেটিং এন্ড সেলস-এর পদ থেকে অবসর নিয়ে আকিজ ফুড এন্ড বেভারেজ-এর এক্সেকিউটিভ ডিরেক্টর, মার্কেটিং এন্ড সেলস হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া ছিল আমার পেশা জীবনের তৃতীয় চ্যালেঞ্জ। মানবিক বিষয়ে পড়ে তিন ধরণের ইন্ডাষ্ট্রিতে টেকনিক্যাল বিষয়ের বুৎপত্তি অর্জন ও উন্নতির শীর্ষে ওঠা আমার নিজেরই গল্পের প্রতিচ্ছবি যেন এ বইতে। ভিন্ন বিষয়ের ছাত্র হয়েও সততা,নিরলস পরিশ্রম, বই পড়ে ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে লক্ষ্যের দিকে একাগ্রতার সাথে পথ চলে এক্সেকিউটিভ থেকে এক্সেকিউটিভ ডিরেক্টর হওয়া ছিল জীবনের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা। ৩৩ বৎসরের কর্মজীবনে একটা বিষয়ই শিখেছি যে, ইঞ্জনিয়ারিং ডাক্তারী সহ বিশেষ কিছু Highly Technical বিষয় ছাড়া যে কোনো বিষয়ে পড়াশুনা করে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি থাকলে যে কোনো ইন্ডাষ্ট্রিতেই উন্নতির শীর্ষে উঠা অবশ্যই সম্ভব। Sharpener প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে দেশের যুব সমাজকে পেশা জীবনের পথ দেখানোর কাজে Soft Skills Training, Personal Mentoring on "How to become a CEO", ও Fourth Industrial Revolution নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। Sharpener-এ প্রফেশনাল ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নীতি-নৈতিকতা-আদর্শে মানুষকে ব্যাক্তিগত জীবন ও ক্যারিয়ারের সমন্বয় করে কিভাবে সত্যিকারের সুখী জীবন যাপন করা যায় তার উপর নিবিড় ভাবে নিয়মিত ট্রেনিং দিয়ে যাচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় Executive to Executive Director বইটি লেখা। এর মধ্যে প্রতিফলিত আমার পেশা জীবনের শীর্ষে ওঠার শ্বাশত সূত্র যা চিরকাল মানুষকে পথ দেখায়ে যাবে। বাবা শরীফ আব্দুর রাজ্জাক ব্রিটিশের অধীনে চাকুরী করতেন কলকাতায়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর তিনি নিজ বাড়িতে চলে আসেন এবং হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করে এবং আলীয়া মাদ্রাসা নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। মা, রিজিয়া বেগম গৃহিনী। জন্ম মাগুরায়। পড়ালেখা ইংরেজি সাহিত্য ও ইসলামিক রিসার্চ এন্ড কম্পারেটিভ রিলিজিওন। ছেলে রাতুল ও মেয়ে মৌ দুইজনই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। স্ত্রী রিনা চাকরি না করে নিবিড় পরিচর্যায় সংসারটাকে পৃথিবীর স্বর্গে পরিণত করেছেন। দুইজন আদর্শ নাগরিকের গর্বিত জননী এবং এই তিন জনের টিমের সফল ম্যানেজার।