"নিষ্ফলা মাঠের কৃষক" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ রাজশাহী কলেজে শিক্ষকপদে তিনি যােগ দেন ১৯৬২ সালের পহেলা এপ্রিল; আর ১৯৯২ সালে ঢাকা কলেজের অধ্যাপক পদটি যেদিন ছেড়ে দেন-সেদিনও ছিল পহেলা এপ্রিল, এপ্রিল ফুলের দিন। দুই বােকা-দিবসের মধ্যবর্তী তিরিশটি বছর শিক্ষকতাকেই জীবনের মহত্তম ব্রত হিসেবে জেনে তিনি নিজেকে নিয়ােজিত রেখেছিলেন। অধ্যাপনায়-যার প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন স্কুল ও কলেজ-জীবনের তাঁর ক’জন শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় শিক্ষক, আর তার অধ্যক্ষ পিতার কাছ থেকে। 'নিষ্ফলা মাঠের' কৃষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের অধ্যাপনা-জীবনেরই স্মৃতিচারণ; এ স্মৃতিচারণার একটি দিক জুড়ে আছে তার স্কুল আর কলেজ-জীবনের শিক্ষকদের কথা। আরাে আছে মুনীর চৌধুরী থেকে শুরু করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পর্যন্ত বেশ ক’জন বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক সস্পর্কে তাঁর নির্মোহ মূল্যায়ন যে মূল্যায়ন শ্রদ্ধা সমালােচনার দ্বন্দ্বে দীর্ণ। জীবনের তিরিশটি বছর অধ্যাপনায় কাটানাের পর সেই ফেলে-আসা দিনগুলির দিকে তাকিয়েছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, দুর্যোগে ধ্বস্ত ক্ষেতের দিকে যেমন করে অশ্রুসজল চোখ আর বুকভরা হাহাকার নিয়ে তাকায় একজন কৃষক। সম্পূর্ণভাবে ধসে-পড়া শিক্ষাঙ্গনের অবক্ষয়গ্রস্ত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাঙ্গন, এর ব্যবস্থাপনার আর মূল্যবােধের দিকে তাকিয়ে নিজেকে তার মনে হয় নিষ্ফলা মাঠেরই কৃষক। তাঁর অপরিসীম ভালােবাসা, তীব্র পর্যবেক্ষণশক্তি ও প্রজ্ঞা মিশিয়ে তিনি অনুসন্ধান করেন এই সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের স্বরূপ ও কারণ। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সহৃদয় রসস্নিগ্ধ সংবেদী কুশলী বর্ণনা এই গ্রন্থটিকে দিয়েছে বহুতলসম্পন্ন বিভা। এই গ্রন্থ একই সঙ্গে স্মৃতিচারণ আর উপন্যাস। বর্ণনার মুনশিয়ানায় চরিত্রগুলাে জীবন্ত ও বৈশিষ্ট্যময়। আবেগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রজ্ঞা, একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষকের মতােই জাতির সামনে তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন। আমাদের শিক্ষাঙ্গনের মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার ছবি, নীরব কিন্তু ভয়াবহতম এই জাতীয় দুর্যোগটির দিকে তিনি ফেরাতে চেয়েছেন জাতির মনােযােগ। এই গ্রন্থ তাই আমাদের সময়ের সবচেয়ে মূল্যবান অন্যতম গ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একইসাথে একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিকও। আর সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে জড়িয়ে থাকায় একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবেও পরিচয় লাভ করেছেন তিনি। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কলকাতার পার্ক সার্কাসে ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কামারগাতি গ্রাম। পাবনা জিলা স্কুল থেকে তিনি মাধ্যমিক এবং বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে এখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ঢাকা কলেজ, রাজশাহী কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেছেন। টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। আর ষাটের দশকে বাংলাদেশে সাহিত্যের এক নতুন ধারা সৃষ্টির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে, এবং একইসাথে 'কণ্ঠস্বর' নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করে নতুন ঐ সাহিত্যযাত্রাকে করেছিলেন সংহত ও বেগবান। শুধু তা-ই নয়, দেশের মানুষের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলে তাদের মাঝে জ্ঞান ও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে তাদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ১৯৭৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র', যা চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে কাজ করে যাচ্ছে এই লক্ষ্যে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমূহ এই ব্যাপারে বিশেষ অবদান রেখেছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'ভাঙো দুর্দশার চক্র', 'আমার বোকা শৈশব', 'নদী ও চাষীর গল্প', 'ওড়াউড়ির দিন', 'অন্তরঙ্গ আলাপ', 'স্বপ্নের সমান বড়', 'উপদেশের কবিতা', 'অপ্রস্তুত কলাম' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক', 'র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার' ইত্যাদি সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।