ভূমিকা অল্পকথায় বহুকথার উপস্থাপনই গল্প। জীবনের কল্পনাজুড়ে এলোমেলো থাকা কথামালার সমষ্টিকরণই গল্প প্রস্তুতকারকের কাজ। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান অনুষঙ্গ থেকেই গল্পের গল্প শুরু হয়। জীবনের ছোঁয়া ব্যতীত গল্প সুনিপূণ হয় না। মাটির বুক দু’ফালা করে যেমন নদী এগিয়ে চলে, ঠিক গল্পও তেমনি জীবনের অলিগলি ঘুরে ভূম-ল-নভোম-লের ঘটনারাজী বগলদাবা করে খানিক জিরোয় আবার ফের ছুটে চলে। গল্পের শুরু আছে শেষ নেই। গল্প শেষের আগেই ফুরোয় গল্পের উৎস, জীবনের লেনদেন। মানুষের জীবনই গল্পের কারখানা। যতটুকু বলা যায়, ঠিক ততটুকুই গল্পাকারে সাক্ষী থাকে। বাকীটুকু আজীবন থাকে সিনাবন্দী। যতটুকু বর্ণিত হয় তাতেই বিচিত্র স্বাদের উপস্থাপন আমাদের মনোজগতে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। লেখকের না বলা শেষ কথাটুকু উপলব্ধি করার সক্ষমতাই বোদ্ধাপাঠকের শক্তি। গল্প তাই শুরু হয়, কখনো শেষ হয় না। ‘ফ্লোরা ও তার ভ্রমণকাহিনী’ ফারাহ্ নূরের প্রথম গল্পগ্রন্থ। তবে তা হৃদয়ক্যানভাস হতে পুরনো গল্পসম্ভার থেকে বেছে নেওয়া কিছু গল্পের ভিন্নধর্মী উপস্থাপন। জীবন নিজেই অনিঃশেষ এক ভ্রমণকাহিনী। কোথাও নীরবে, কোথাও খরস্রোতা তটিনীর মতো বয়ে চলে। নদীর ক্রন্দনের সুর যেমন বাতাসের হিমেল আবহে মিশে যায়, তেমনি গল্পের প্রেক্ষাপট মেঘেদের সীমানা ঘেষে ভেসে বেড়ায়। আর তা কেউ কেউ শুধু দেখে থাকে। ফ্লোরার ভ্রমণকাহিনী মূলত আমাদেরই ভূমিতে আর জীবনানন্দের ধূসর জগতে। তাই জাগতিক ভাবনার ফিরিস্তি বিস্তৃত আকারে ফুটে উঠেছে। পদব্রজে নয়, এ-ভ্রমণ আত্মিক। আর্থিক অনুষঙ্গ-ভ্রমণলীলায় গণ্য নয়। তবে হৃদয়ঘটিত ভ্রমণ বলে কিছু সুখ কিছু বেদনাও এখানে কারবার আকারে উপস্থিত হয়েছে। মেঘের রূপোলীসুতোর আগায় বাঁধা জীবন আর কতটুকু যেতে পারে, লাটাই তো অদেখা নিয়ন্ত্রকের হাতে। একসময় শুষ্কপাতা ঝরে পড়ার মতো নিস্তব্ধতার মধ্যেই জীবনের অবসান হবে। তবে কী গল্প শেষ হবে? সাধারণত প্রথম সন্তানের নামানুসারেই মাতাপিতার মাতৃত্ব-পিতৃত্বের পরিচয় ঘটে। পাড়া-পড়শীসহ জ্ঞাতিগোষ্ঠীরা প্রথম সন্তানের নাম ধরেই তাদের ডাকে। এ-গল্পগ্রন্থের বেলায়ও এমন কারবার ঘটেছে। প্রথম গল্পের নামানুসারেই বইয়ের নামকরণ হয়েছে। জীবনের উত্থান-পতনের মধ্যেই সমস্ত গল্প। মানুষের কৃতকর্মের ফলাফল দুর্ভেদ্য বেষ্টনী খানখান করে ফিরে আসে। এ-ফল ভোগ না করে কোনো পরিত্রাণ নেই। বিভিন্ন আঙ্গিকে, বিচিত্র ঘটনা আর কুশীলবের সমন্বয়ে বোধ হয় গল্পকার এ-কথাগুলোই আমাদের স্মরণের ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। আমি আশাবাদী মানুষ। আশার হিরন্ময় প্রদীপ আমাকে নিয়ত পথ দেখায়। তাই বলতে পারি, গল্পগুলো পাঠকের মন ছুঁয়ে যাবে। গল্পগুলো শোধরিয়ে দেবে কিছু আনন্দমাখা ভুল। ফারাহ্ নূর গল্পকথনের মধ্যে দিয়ে স্বতন্ত্র একটি স্বরের আবির্ভাব হউক গল্পজগতে।
মোহাম্মদ আলম চৌধুরী শিক্ষক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়