আমার মনে হাজারো কথার ঢেউ খেলে গেলেও এতক্ষণ ধরে নির্বিকার ছিলাম। হুজুরের কথার পৃষ্ঠেও মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেল আরও কিছু কথা : চিকিৎসা বিদ্যার জনক কে? কোন হিন্দু? বৌদ্ধ? খ্রিষ্টান? নাকি মুসলমান? আজ অবধি কারা এ বিদ্যার সুবিধা গ্রহণ করেছে? কোনোও নির্দিষ্ট শ্রেণি-গোষ্ঠি কি? আবার ইদানিংকার বড় বড় সব বালাই ব্যাধির প্রতিষেধক, প্রতিরোধকগুলোর আবিষ্কারক, গবেষকই বা কারা? তা থেকে চিকিৎসা নিয়ে বেঁচেই বা উঠছে কারা? কোনোও নির্দিষ্ট শ্রেণি-গোষ্ঠী কি? যে সাবান সুগন্ধি জগৎ জুড়ে আধুনিক সভ্যতার উন্মুক্ত প্রাণরস, তারই বা আদি আবিষ্কারক কারা? মহান সব আবিষ্কার, যেসবের কল্যাণে নিঃসীম আকাশে, অতল মহাসমুদ্রে পাড়ি জমানো হচ্ছে কিংবা কলকারখানার চাকা ঘুরিয়ে বেঁচে থাকার রসদ মিলছে, অন্ধকারের বিভিষিকায় ঝলমলে আলো ফোটানো যাচ্ছে, সেসবের মহান আবিষ্কারকগণ শুধুই নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠী শ্রেণির কল্যাণের ব্রত নিয়ে সেসব আবিষ্কারে ব্রতী হয়েছিলেন কি? আর এই যে সর্পিল দীর্ঘশরীরি ট্রেন, যার কল্যাণে এ মাত্রই এতগুলো লোক এতটা সহজে ও সংক্ষিপ্ত সময়ে এতটা পথ পেরিয়ে এলাম, তারই বা আবিষ্কারকের ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী কী? কাদের কল্যাণ চিন্তা মাথায় নিয়ে তিনি এ যন্ত্রযান আবিষ্কারে ব্রতী হয়েছিলেন? কারা এর সুফল ভোগ করছে? কোনোও নির্দিষ্ট গোষ্ঠী শ্রেণি কি? একজন সাদা চামড়াধারী তার সাদা চামড়ার শ্রেষ্ঠত্ব কালোহীনতায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম কি? তুমি সাদা, আমি সাদা, সেও সাদা-কে শ্রেষ্ঠ তবে? কেউ মূর্খ না হলে বিদ্যানের বিদ্যাশ্রেষ্ঠত্ব কী? কেউ দরিদ্র না হলে ধনীর ধনশ্রেষ্ঠত্ব? কেউ গোত্রে খর্ব না হলে গোত্রধারীর গোত্রশ্রেষ্ঠত্ব? কেউ ভৃত্য না হলে মনিবের মনিবী শ্রেষ্ঠত্ব? নৈপথ্যে যে শ্রেষ্ঠত্বে ঠেলে দেয় তার নিকৃষ্টত্ব কী? যদি তা না থাকে তবে কেন এত বিভাজন? কেন এত হানাহানি, ভেদাভেদ? কোন্ গ্রন্থে এসবের সায় মিলেছে? কোরান, বাইবেল, ইঞ্জিল, গীতা, নাকি ত্রিপিটকে? মনের ভেতরে ফেনিয়ে ওঠা কথার ঢেউ মনেই মিলেয়ে গেল; একটিরও বলার সুযোগ হলো না। কারণ, ট্রেন এরই মধ্যে পরবর্তী স্টেশনে এসে থেমেছে। এখানেই আমার গন্তব্য বিধায় তড়িঘড়ি ব্যাগপত্তর নিয়ে নামার উদ্দেশ্যে পা বাড়াই। মনে মনে ভাবি, কিছু বলা না হলেও পরিতোষের বিষয় এই যে অনেকটা সময় ধরে আমি ছিলাম আমার মননে মগজে এইসব কথার ঢেউ উৎরে দেয়া বেশ একদল সাধারণ অসাধারণ মানুষের পথসঙ্গী!
শওকত নূর লেখক পরিচিতি: শওকত নূর কথাসাহিত্যিক, কবি ও ছড়াকার। লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন দীর্ঘদিন। গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি পত্র পত্রিকায় লিখছেন নিয়মিত। আলােচিত উপন্যাস নিঃস্তব্ধ অন্ধকার’ এর মধ্য দিয়ে গ্রন্থে আত্মপ্রকাশ। অন্যান্য পাঠকপ্রিয় উপন্যাসের মধ্যে রাত্রি শেষে, নূপুর, তৃষ্ণার সাথে, স্বপ্ন দেখা ভাের, অপেক্ষমাণ, সেই শেষ দেখা, গােধূলির কথা, অশ্রু প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। গল্পগ্রন্থ বিতৃষ্ণা, শেষ কথা, ছায়া মানুষ, এক সন্ধ্যার ভালােবাসা, বন্ধু, নতুন জীবন, শুভরাত্রি প্রভৃতি সমধিক জনপ্রিয়। ছােটোদের জন্যও তিনি লিখে যাচ্ছেন নানা আঙ্গিকে। কিশােরগল্প পাগলা দাদার কাণ্ড, ভুলু মাস্টারের ভূতের স্কুল, ভূতের ডাক্তার, ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ, তিন উন্মাদের গল্প, রাখাল, বাঘা, টপু ও এক ঝক দেশি পেঁচা, ছড়াগ্রন্থ ডাবলু মামা ও হাবলু গামা, হুক্কাহুয়া, চাঁদের দেশে প্রভৃতি বহুলপঠিত। ‘ধূসর নীল সমুদ্রে’ গল্পগ্রন্থে তিনি হাজির হয়েছেন একগুচ্ছ অনন্য সাধারণ গল্প নিয়ে।। কথাসাহিত্যিক, কবি ও ছড়াকার শওকত নূর এর জন্ম টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী থানার হাতিয়া গ্রামে। জন্ম তারিখ ৭ মার্চ ১৯৭০। তিনি পড়াশােনা করেছেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে পেশা শিক্ষকতা ও লেখালেখি। কর্মস্থল রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী ইনজিনিয়ারিং ইউনিভারসিটি স্কুল এন্ড কলেজ।