বই নিয়ে সামন্য কথা পঞ্চদশ শতাব্দীর মহান ধর্মগুরু কবীর। হিন্দুধর্ম ও ইসলাম, এই দুটি প্রধান ধর্মের অর্থহীন আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড ও লোকাচারকে সমালোচনা এবং আক্রমণ করে, আর দুটিরই চরম লক্ষ্য যে এক এবং অভিন্ন, এই শিক্ষা দিয়ে কবীর দুটি ধর্মকে পরস্পরের কাছাকাছি আনতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ছিলেন রামের একনিষ্ঠ ভক্ত। তাঁর রাম মুসলমানের রহিম থেকে মোটেই ভিন্ন নন। প্রেমের এবং রামের কাছে আত্মনিবেদনের ক্ষেত্রে তাঁর ভাষা মধুর এবং প্রশান্ত, কিন্তু সমাজ-সংস্কারের ক্ষেত্রে সেই ভাষাই হয়ে উঠেছে অত্যন্ত তীব্র এবং উত্তেজনা-উদ্দীপক। নানক এবং অন্যান্য শিখগুরুরা তাঁর সম্বন্ধে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। তিনি হিন্দুদের জাতিভেদ-প্রথার কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি প্রতিমাপূজার বিরুদ্ধে, ঈশ্বরের অবতারবাদের বিরুদ্ধে এবং অন্যান্য ধারণার বিরুদ্ধে নির্মমভাবে বলেছেন। কবীর নিজের ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক অনুভ‚তির গভীরতা এবং চিন্তার মহত্ত¡ অত্যন্ত সহজ ভাষায় এবং অকৃত্রিম ভঙ্গিতে প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন, তাতেই তাঁর কবিতা মহিমান্বিত হয়েছে। পরমাত্মার সঙ্গে যখন তিনি স্বর্গীয় প্রেমে বিভোর হয়ে থাকেন তখনই তাঁর রচনার চরমোৎকর্ষ ঘটেÑ ‘শোনো ভাই সাধু, সে বুঝতে পারে, কে তাকে ভালোবাসে। যদি তোমার মনে তোমার প্রেমাস্পদের জন্য প্রেমের ব্যাকুলতা না জাগে তবে বৃথা তোমার দেহসজ্জা, বৃথাই তোমার চোখের পাতায় কাজল দেওয়া।’ মধ্যযুগের ভারতীয় জীবনে এবং সাহিত্যে কবীর অসামান্য প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। হিন্দিতে একমাত্র অন্য এক ভক্তিমার্গের ভক্ত কবি তুলসীদাসের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিত্বের মহিমার তুলনা চলে। এই বইখানিতে ধর্মবিষয়ে পরমতসহিষ্ণুতার, ভ্রাতৃভাববিস্তারের, সমাজ-সংস্কারের এবং সাহিত্যিক গভীরতার দিক দিয়ে এই সন্তকবির দান সম্বন্ধে সুন্দর বিবরণ দেওয়া হয়েছে। যাঁরা সার্বজনীন ধর্মের অনুরাগী এবং যাঁরা উচ্চশ্রেণির সাহিত্যের ভক্ত, এই বইখানি নিঃসন্দেহে তাঁদের সাদর অভ্যর্থনা লাভ করবে।