একাত্তরের মার্চ বাঙালির অস্তিত্বের উদ্ভাসন ১৯৭১-এর মার্চ মাসে সমগ্র বাংলাদেশ গণজাগরণের জোয়ারে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রতিটি প্রাণে স্পন্দিত হয়েছিল- স্বাধীনতার স্বপ্ন, মুক্তির আকাক্সক্ষা। আর সেই স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার পেছনে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মত সুর গেঁথেছিলেন যিনি তিনি হচ্ছেন, বাঙালি জাতির অবিসম্বাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিটি বাঙালির হৎপিণ্ডের তারে তিনি তুলে ছিলেন সংগ্রামের দামামা। সাড়ে সাত কোটি মানুষের চোখে এঁকে দিয়েছিলেন এক অকুতোভয় সাহস। সবার বুকে এবং মুখে তুলে দিয়েছিলেন মৃত্যুঞ্জয়ী মন্ত্র, এক অবিনাশী শ্লোগান- ‘জয় বাংলা।’
কবি কিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই বাণী যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিল উত্তাল মার্চের দিনগুলিমাসে আমাদের এই ছাপ্পান্নো হাজার বর্গ মাইলের বাংলাদেশে। মার্চে একাগ্র একাট্টা হয়ে উঠেছিল সমগ্র দেশের মাটি ও মানুষ। তাদের অভীষ্ঠ গন্তব্য হয়ে উঠেছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা- শোষণের শৃঙ্খল ছিঁড়ে, দুঃশাসনের শেকড় উপড়ে ফেলার প্রেরণায়।
পৃথিবীর ইতিহাসে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে বিদ্রোহের উদাহরণ ছাড়া এমন গণজাগরণের মহাকাব্যিক উত্থানের আর কোনো নজীর আছে কিনা আমার জানা নেই। আর সেই মহাকাব্যের অমর কবি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ মার্চে রেসকোর্সের মহাজনসমুদ্রে তাঁর বক্তৃতা সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে জাগিয়ে তুলেছিল- আজ পৃথিবীর শত শত কোটি মানুষ তাঁর সেই মহাকাব্যের বাণী ও সুরে বিস্মিত, মুগ্ধ, অনুপ্রাণিত। তাই একাত্তরের মার্চে যে মন্ত্রবীজ বাঙালি জাতিকে জয় ছিনিয়ে আনতে মরণজয়ী প্রতিজ্ঞায় ইস্পাত কঠিন ঐক্যে লক্ষ্য অর্জনে সফল করেছিল, আজও সেই ৭ মার্চের মহাকাব্য মানব জাতির মুক্তি মন্ত্রের মতো অনুরনণিত পৃথিবীর সমস্ত ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। ‘জয় বাংলা’ শুধু বাঙালির শ্লোগান নয় ‘জয় বাংলা’ পৃথিবীর মানবমুক্তির শ্লোগান। তাই উনিশ শ’ উত্তাল মার্চের দিনগুলিশুধু বাংলাদেশের আর বাঙালি জাতির মুক্তির পথ প্রদর্শক নয় উত্তাল মার্চের দিনগুলিগোটা পৃথিবীর মানবতার মুক্তির উদ্ভাসন মানবতার জয়ের বীজ মন্ত্র।
সুহদ মুক্তিযোদ্ধা আলী ইদরীস তাঁর ‘উত্তাল মার্চের দিনগুলি’ বইয়ে সেই মহাকাব্যকেই তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। একুশ শতকের পাঠকের হৃদয়ে সেই সুর রণিত হলেই এ গ্রন্থের সার্থকতা। সত্তর দশকের তরুণ কবি ও সুলেখক আলী ইদরীস সাবলীল ভাষায় একাত্তরের মার্চের ভয়ংকর দিনগুলোকে চমৎকারভাবে এ বইয়ে তুলে এনেছেন। ফলে ‘উত্তাল মার্চের দিনগুলি’ স্মৃতিকথা হয়েও এ বই ব্যক্তিগত রচনা নয়, হয়ে উঠেছে ইতিহাসের উপকরণ সংরক্ষণভান্ডার। আশা করি এ বই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের হৃদয় যেমন স্পর্শ করবে, তেমনি আগামী প্রজন্মের কাছেও জাতির সবচেয়ে বড় গৌরব আর সবচেয়ে বড় ত্যাগের বেদনাবহ এই স্মৃতিময় রচনা আকর্ষণীয় পাঠ্য বলে বিবেচিত হবে।