‘যাত্রার ইতিবৃত্ত’ নামে যে গ্রন্থ মজিদ ভাই রচনা করেছেন, তা যাত্রাগানের প্রচলিত ইতিহাস নয়। যাত্রাগানের অপ্রচলিত অনেক তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছেন, বাঁকে-বাঁকে লুকিয়ে থাকা অনেক মণিমুক্তা সংগ্রহ করে তিনি পরিবেশন করেছেন। যাত্রার উদ্ভবকালের কথা বলেছেন বিদগ্ধজনের মন্তব্য উদ্ধার করে। যাত্রাপালায় বিবেকের গানের অপরিহার্য আলোচনা এই গ্রন্থের মর্যাদা বাড়িয়েছে। যাত্রাশিল্পে নারীর অবদান পৃথকভাবে চিহ্নিত করে তিনি নিবন্ধ রচনা করেছেন। আমাদের থিয়েটারে অর্থাৎ ভদ্রসমাজের মঞ্চে যেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনাদর্শ অনুপস্থিত, সেখানে সাধারণ মানুষের যাত্রামঞ্চে বঙ্গবন্ধু এসেছেন স্বমহিমায়। এসব কৃতিত্বের কথা নিয়ে আমার অভিসন্দর্ভে আমি আলোচনা করেছি। পরে যাত্রাবিশেষজ্ঞ মিলনকান্তি দে এই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। এবার এম এ মজিদ লিখলেন একই বিষয় নিয়ে বিস্তৃতভাবে। বাংলাদেশের যাত্রাপালা ও পালাকারদের পরিচিতি নিয়ে তাঁর অনুসন্ধানী আলোচনা রয়েছে এই গ্রন্থে। বাংলাদেশে নিবন্ধিত যাত্রাদলের তালিকাও এই গ্রন্থের অবয়বকে সমৃদ্ধ করেছে। এছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে দেশের ৬৪টি জেলায় মঞ্চস্থ ৬৪টি যাত্রাপালা ও পালাকারদের তালিকাও এই গ্রন্থের আকর হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া যাত্রা নির্দেশকদের নাম, দেশের যাত্রাদলে পরিবেশিত দর্শকপ্রিয় পালার একটি দীর্ঘ তালিকা, বিস্মৃতপ্রায় যাত্রাঙ্গিক মানিকযাত্রার বিবরণ এবং যাত্রাপালায় গানের ব্যবহার নিয়ে এম এ মজিদের আলোচনা সুধীজনের কাছে গুরুত্ব পাবে বলে আমাদের ধারণা। গ্রন্থের শেষে রয়েছে ৫টি যাত্রাপালায় ব্যবহৃত গানের সংকলন। এসব আমাদের লোকসংস্কৃতির তাৎপর্য অঙ্গ। এগুলোকে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এম এ মজিদের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। যাত্রাগান নিয়ে এদেশে প্রথম গবেষণা করেন নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কাজটি ছিল উপমহাদেশের প্রথম পিএইচডি পর্যায়ের কাজ। তারপর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রকাশ করে মঈনউদ্দিন আহমেদের ‘যাত্রার যাত্রা’ নামের গ্রন্থ। এরপর বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় আমার গবেষণাগ্রন্থ ‘বাংলাদেশের যাত্রাগান: জনমাধ্যম হিসেবে সামিাজিক পরিপ্রেক্ষিত’ নামে। এটি আমাদের দেশে নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পরে দ্বিতীয় পিএইচডি সন্দর্ভ। এর আগে-পরে আমার আরো দুটি গ্রন্থ রয়েছে যাত্রাগান নিয়ে। এরপর মিলনকান্তি দে-র গ্রন্থ এই ধারার নতুন সংযোজন। যাত্রা নিয়ে আপাতত শেষ গ্রন্থটি লিখলেন এম এ মজিদ। এছাড়া যাত্রা নিয়ে গবেষণা করেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মার্জিয়া আক্তার। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি বিভিন্ন সময়ে একাধিক পুস্তিকা ও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যাত্রাগান নিয়ে। এই তথ্যগুলো প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায় এই পরিবেশনকলা নিয়ে কাজের সুযোগ রয়েছে। এম এ মজিদের এই গ্রন্থের ধারাবাহিকতায় আরো গবেষণা পরিচালিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। গ্রন্থটি সকল মহলে সমাদৃত হোক, এই প্রত্যাশা রইল।