নারীর প্রতি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের যে মনোভাব তা বোঝার জন্য ‘কোনো’ রাষ্ট্র প্রশ্ন করার প্রয়োজন পড়ে না। সকল রাষ্ট্রেই নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয়। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে হয়তো ধরন ও মাত্রার কিছুটা ভিন্নতা ও কম বেশি রয়েছে। তাই তো প্রায় ছ’হাজার মাইল দূর দেশে থেকে কালো নাইজেরিয়ান নারীরা যে পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে তা এই আপাত ‘উন্নয়নশীল’, নারী অগ্রযাত্রার দেশে বসেও উপলব্ধি করা যায়। সেই নারীদের প্রতি প্রতিনিয়ত ঘটমান অন্যায়, অসহযোগের মাত্রা, তার প্রতি আগ্রাসী আচরণ টের পাওয়া যায়। যে আগুন জ্বলছে তার ওম ঠিক এখানে বসেও গায়ে এসে লাগে। চিমামান্দার বইগুলো যেন আমাদেরই কথা বলে। যেন তিনি আমাদের পাড়ায় থাকেন। রোজ ভিড় বাসে, পায়ে হেঁটে বা গাড়ি করে আমাদেরই পথ পাড়ি দেন। মনে হয় না দেশ, কাল, সীমানা প্রাচীর নারীর অবস্থানকে কিছুমাত্র বদলাতে পারে। জন্মের আগে থেকেই পুত্র সন্তানের প্রত্যাশা, মেয়ে শিশুর প্রতি অবজ্ঞা, তার লালন-পালন, তার প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা, জীবন-সঙ্গী নির্বাচন ও নির্বাচনের প্রক্রিয়া, বিয়ে, বিয়ে পরবর্তী জীবন, সাংসারিক দায়িত্ব, সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্তসহ ছোট থেকে বড় কোনো ক্ষেত্রেই নারীর নিজের কর্তৃত্ব নেই। তার কাজ কেবলই অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকা, অন্যের মুখের দিকে চেয়ে থেকে জীবন কাটিয়ে দেয়া। কোথাও এর অন্যথা নেই। কিন্তু নিশ্চয়ই কোথাও এর শেষ আছে। কোথাও নতুন শুরু আছে। শত বছরের পুরনো নদীর পথও কখনো বদলায়, পুরনো তীর ভেঙে যায়। নোঙর করা নৌকার ঠিকানাও বদলায়। সময়ের এই পরিবর্তন আটকানোর জো নেই। বিশ্বে নারীর অবস্থান এখন যেমন গত শতাব্দীতে নিশ্চয়ই তেমন ছিল না, তার আগের শতাব্দীতেও নিশ্চয়ই গত শতাব্দীর ছায়ামাত্র ছিল না। পারিবারিক-সামাজিক কাঠামো, নাগরিক সংস্কৃতি সকলই ধারা-বদলের মধ্য দিয়ে পরের সকালের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মহাকালে এইসবই ইতিহাস। এই ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে মানুষ একদিন কেবল মানুষ হবে। মানুষের নাম-ঠিকানা, ধর্ম-গায়ের রং, পাসপোর্ট সেখানে একটা পরিচয় বৈ কিছু নয়। ব্রাহ্মণ-শূদ্র, কোটিপতি-দিনমজুর, সাদা-কালোর বিশ্বে প্রকট হয়ে আছে একের হাতে অন্যের স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র। কালো বা বাদামিরা যেখানে শোষিতের চূড়ান্ত রূপ। কিন্তু শোষিতের হাতে আরও শোষিত হন কালো নারীরা। চিমামান্দা শৈশব থেকেই সেই শোষণ দেখেছেন। দেখেছেন কী করে সাদাদের দুনিয়ায় টিকে থাকতে কালোরা লড়াই করে গেছেন আজীবন, আর দেখেছেন সেই লড়াই করে টিকে থাকা মানুষগুলোও কী করে তারই মতো মানুষদের ওপর শুধুমাত্র নারী হবার কারণে শোষণ করে যাচ্ছেন। যেখানে কালো হবার আন্দোলনকে স্বীকৃতি দেয়া হয় সেখানে লিঙ্গ পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে যে নারীকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে তার স্বীকৃতি মেলে না। নারীর সমতার আন্দোলনকে হেসে বাতিল করে দেয়া হয়। কেউ শোষিত হলেই যে অন্যের যন্ত্রণা বুঝবে, নিপীড়িতের আহাজারি, তার ক্ষরণে ব্যথিত হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই; তার টেক্সটবুক এক্সাম্পল এই বইখানি। বইটি নাইজেরিয়ার প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও বাংলাদেশে বর্তমান কালে নারীরা প্রতি পদে যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন, রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক হয়রানির শিকার হন তার পরিস্থিতি বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে।