"বৌদ্ধযুগের ভারত" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ বৌদ্ধধর্মের বিস্তারের সূত্রেই যে চীনদেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের একটা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক যােগাযােগ বিশেষভাবে গড়ে উঠেছিল- তা ঐতিহাসিক সত্য। খ্রিষ্টীয় ৬৭ অব্দের কাছাকাছি সময়ে চীনদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রচার শুরু হয়। এই সময়েই চীনরাজ মিংটীর আমন্ত্রণক্রমে বশ্যপ- মাতঙ্গ ও ধর্মরক্ষ নামে দুজন ভারতীয় সন্ন্যাসী চীনদেশে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। তাঁরা ছাড়াও বহু ভারতীয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দুর্গম পথ অতিক্রম করে বহু ক্লেশে চীনে ধর্ম প্রচার করতে যান। ধীরে ধীরে প্রায় সাড়ে চারশাে বছরের মধ্যে চীনে বৌদ্ধধর্ম একাধিপত্য বিস্তার করে। পরবর্তীকালে চীন থেকেও বহু পরিব্রাজক বুদ্ধের দেশ ভারতবর্ষে নানা আয়াস স্বীকার করে আসতে থাকেন। প্রথম যে প্রধান পরিব্রাজক চীন থেকে ভারতে আসেন (৪০০ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি ফা-হিয়ান। ফা-হিয়ান যে বিবরণ রেখে গেছেন- তা অতীব মনােরম। কিন্তু এখানে যে মনােরম সংবাদটি আগে দেওয়া প্রয়ােজন তাহলে বিশ্বের কাছে যে উপমহাদেশটি চীন নামে খ্যাত, তার এই নামকরণ করেছিলেন ভারতীয়রাই। যেসব ভারতীয় নাবিক বাণিজ্য করতে যেতেন খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয়-তৃতীয় শতক নাগাদ তাঁরা সেই দেশের রাজার নাম শীন জেনে গােটা দেশটিকেই ‘চীন’ (< শীন) নামে ডাকতে থাকেন। তেমনি ভারতবর্ষও চীনাদের কাছে পরবর্তীকালে ‘ভারত’ নামে ততখানি পরিচিত ছিল না যতখানি ছিল ‘ফো-দিয়াং' নামে। ফো-দিয়াং' শব্দের অর্থ বুদ্ধের দেশ। মাত্র শতখানেক বছর আগে সুবিখ্যাত শরৎচন্দ্র দাস যখন চীনে যান, তখনও ‘ভারত থেকে তিনি এসেছেন এ পরিচয়ে পরিচিত হতে পারেননি। কিন্তু যখন তাঁরা জেনেছিলেন, যে শ্রীদাস ‘ফো-দিয়াং' থেকে এসেছেন, তখন তাঁরা সাদরে তাঁকে বরণ করে নিয়েছিলেন। বুদ্ধের দেশ ভারতবর্ষ সম্পর্কে এই যে শ্রদ্ধাবােধ গড়ে উঠেছিল চীনদেশের অধিবাসীদের মধ্যে, তাঁর একটি প্রধান কারণ যেমন ছিলেন ফা-হিয়েন, তেমনি আরও একজনের বিশিষ্ট ভূমিকা সক্রিয়ভাবে লক্ষ করা গিয়েছিল। তিনি হিউয়েন সাঙ। ভারত ভ্রমণ করে ফা-হিয়েন স্বদেশে ফিরে গিয়েছিলেন ৪১৪ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর প্রত্যাবর্তনের প্রায় ছয়শাে বছর পরে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ হিউয়েন সাঙ ভারতবর্ষের উদ্দেশে রওনা হন তাঁর প্রায় তিরিশ বছর বয়সে (জন্ম ৬০১ বা মতান্তরে ৬০৩ খ্রিষ্টাব্দ)। প্রায় পনেরাে বছর ভারতের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করে তিনি ৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ স্বদেশে ফিরে যান। ফিরে যাওয়ার পর তৎকালীন চীন সম্রাট থাইচুঙ-এর অনুরােধে তাঁর ভ্রমণের একটি বিশ্বস্ত বিবরণ লেখেন। এটি পৃথিবীতে ‘সি-ইউ-কি' নামে পরিচিত। ইংরেজি ভাষায় এর অর্থ হলাে-Buddhist Records of the Western World, সম্রাট হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে (৬০৬-৬৪৬) তাঁর আগমন ঘটে। এ সময়ের মধ্যেই বৌদ্ধধর্ম পৃথিবী জয়ে সমর্থ হয়েছিল। মানচিত্রটিকে আমরা বৌদ্ধ ভারত' বলে চিহ্নিত করতে পারি। সেজন্য সি-ইউ-কি বইটিকে, আসলে, হিউয়েন সাঙ বৌদ্ধ ভারতকে যেমন দেখেছিলেন- মুখ্যত তারই বিবরণ বলা যেতে পারে। এই নামটিই সাধারণের কাছে গ্রহণযােগ্য হবে ভেবেই আমরা ‘সি-ইউ-কি' গ্রন্থকার প্রদত্ত এই নাম রেখেও বর্তমান বইটির নামকরণ এমনতর করেছি। ভরসা করি এতে কোনাে ভ্রান্তি ঘটবে না।