নবকুমার, কিংবদন্তি লেখক সমরেশ মজুমদারের অসাধারণ ট্রিলজি উপন্যাসের অসামান্য এক চরিত্র। এর সাথে যেন পরােক্ষে যুক্ত হয়ে আছে লেখক সমরেশের আত্মজৈবনিক সময় এবং পরিপার্শ্ব। কিন্তু কে এই নবকুমার? কী তার পরিচয়? উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ভাগ্যের অন্বেষণে যুবক নবকুমার রওয়ানা দেয় কলিকাতার উদ্দেশ্যে। সফরসঙ্গী যাত্রাদলের মাস্টারদা নবকুমারকে প্রথমেই নিয়ে এলেন বিশ্বখ্যাত পতিতালয়। সােনাগাছিতে, তার পরিচিত পুরনােদিনের যাত্রার নামী অভিনেত্রী ‘শেফালি-মা’র ডেরায়। আর সেখানেই মনের অদ্ভুত রসায়নে। শেফালি-মা’র ভালাে লেগে গেল ছেলেটিকে। তারপর শুরু হয় নবকুমারের জীবনে অদ্ভুত পরম্পরা-ঘটন-অঘটন। প্রতিমুহূর্তে সৎ, সত্যভাষী নবকুমারের মনে হতে থাকে এই অচেনা শহরে সে বেমানান। এদিকে যাত্রাদলের বড়বাবু সিনেমার একজন প্রযােজকও। নবকুমারকে তিনি নির্বাচন করেন তার পরবর্তী সিনেমার নায়ক হিসেবে। টালিগঞ্জের নতুন নায়ক হওয়ার অপ্রত্যাশিত সুযােগ আসে নবকুমারের কাছে। জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার এইরকম চমৎকার সুযােগ কি নবকুমার হেলায় হারাবে? নবকুমার কি শেষপর্যন্ত মানিয়ে নিতে পারলাে কলিকাতা শহরের সঙ্গে? অসাধারণ এই সিকুয়েল উপন্যাসের প্রথমটি কলিকাতায় নবকুমার; ‘ক্যালকাটায় নবকুমার’ সিকুয়েল শেষ হয়েছে ‘ফিল্মস্টার নবকুমার’-এ এসে। সিকুয়েলের পুরােটা জুড়ে উঠে এসেছে। নবকুমার-এর আলাে-অন্ধকারের বর্ণময় জীবন, তারপর সবকিছু ছেড়ে একদিন মাটি আর নাড়ির টানেই সে ফিরে যায় তার আজন্ম। শৈশবভিটায় কিন্তু কেন? কী এমন জীবন অভিজ্ঞান নবকুমারকে তাড়িত করেছিল জন্মভিটায় ফিরে যেতে? এইরকম জীবনের শতগুঢ় প্রশ্নের উত্তর মিলবে এই ট্রিলজি উপন্যাসে। সমরেশ মজুমদারের এই উপন্যাসত্রয়ী শুধু বৃহৎ উপন্যাসের তকমাতেই সীমাবদ্ধ নয়; এ যেন গ্রাম ও শহরের দ্বান্দ্বিকতা, নগর সংস্কৃতি- এক যুবকের জীবনদর্শন- তারই জীবনালেখ্যের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে তীব্র ও তীর্যকভাবে এবং পাঠককে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে চূড়ান্ত মানবিক প্রশ্নের সামনে।
১৯৪২ সালের ১০ই মার্চ পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে জন্ম বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদারের। তাঁর শৈশব কাটে প্রকৃতির কোলে, চা বাগানে ঘুরে, আদিবাসী শিশুদের সাথে খেলে। এ কারণেই সমরেশ মজুমদার এর বই সমগ্রতে বারবার উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, চা বাগান, বৃষ্টি কিংবা পাহাড়ের কথা। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় জলপাইগুড়ির জেলা স্কুল থেকে। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তাঁর ছিল ভীষণ ঝোঁক। মঞ্চনাটকে চিত্রায়নের উদ্দেশ্যে তিনি সর্বপ্রথম ‘অন্তর আত্মা’ নামের একটি গল্প রচনা করেছিলেন। সেই গল্পে নাটক মঞ্চায়িত না হলেও পশ্চিমবঙ্গের পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এ প্রকাশিত হয় গল্পটি। সেই থেকেই শুরু তাঁর লেখকজীবন। সমরেশ মজুমদার এর বই বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ পড়েন, পড়তে ভালোবাসেন। দুই বাংলাতেই তিনি সমান জনপ্রিয়। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে বিখ্যাত হলেও, ছোটগল্প, কিশোর উপন্যাস, নাটক, চিত্রনাট্যসহ, গোয়েন্দাকাহিনীও রচনা করেছেন। সমরেশ মজুমদার এর বই সমূহ, যেমন- সাতকাহন, গর্ভধারিণী, মৌষকাল, ট্রিলজি- উত্তরাধিকার-কালবেলা-কালপুরুষ, আট কুঠুরি নয় দরজা ইত্যাদি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র অনিমেষ, মাধবীলতা, দীপাবলী আর জয়িতা পাঠকমনে আজও বিরাজমান। সাহিত্যে তাঁর অনন্য এবং অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন সময়ে আনন্দ পুরস্কার, সত্য আকাদেমী পুরষ্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং আইআইএমএস পুরস্কার অর্জন করেছেন।