প্রস্তাবনা বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব ছিল একান্তভাবে আকস্মিক। বাংলা সাহিত্যের . বিদগ্ধ সমালোচকদের অনেকেই শরৎচন্দ্রকে বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে তৃতীয়তম ঔপন্যাসিকরূপে অভিহিত করেছেন। বলাবাহুল্য সমালোচকদের বিচারে বঙ্কিমচন্দ্রের স্থান হ'ল প্রথম। রবীন্দ্রনাথ হলেন দ্বিতীয়। কিন্তু অদ্বিতীয় কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের স্থান কোন মৌল দোষের পরিপ্রেক্ষিতে তৃতীয় হ'ল তা এককথায় বলা কঠিন এবং আয়াসসাধা ব্যাপার। সমালোচকদের যুক্তিও এই ব্যাপারে খুব ঋজু নয়। অবশ্য বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসের কালগত বিচারে শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব কাল অনুযায়ী তাঁর স্থান যে তৃতীয় হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু রচনাগত গুণের বিচারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত শরৎচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অদ্বিতীয় ঔপন্যাসিক। বঙ্কিমচন্দ্র অবশ্যই বাংলা উপন্যাসের জনক। রবীন্দ্রনাথ ঘটিয়েছেন বাংলা উপন্যাসের যুগানুযায়ী অগ্রগতি। কিন্তু বঙ্কিম ছিলেন মূলত শিল্পী। সমাজের নৈতিক মেরুদণ্ড মজবুত রাখার কাজেই তিনি সাহিত্যকে কাজে লাগিয়েছেন। তাই সাধারণ ও সহজ মানুষের চেয়ে আদর্শবান মহৎ মানুষই তাঁর রচনায় বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। এবং মানুষের দোষ ত্রুটি অনৌচিত্যকে তিনি কঠিন ভাবে দণ্ড দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য বাস্তব দুঃখ বেদনাকে অস্বীকার করেন নি। কিন্তু দুঃখোতীর্ণ মহাজীবনের বাণীই প্রকট হয়েছে তাঁর রচনায়। এই কারণেই তাঁর সাহিত্যে মানুষ ততটা রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে আসেনি, যতটা এসেছে এক-একটি মানবায়িত ভাব ও প্রতিভার প্রতিভূ হয়ে। তাছাড়া বঙ্কিমের মতই তাঁর সৃষ্ট মানুষরাও সবাই সমাজ সৌধের উঁচু তলার বাসিন্দা।
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।